2 of 3

বাংলা সংস্কৃতি চলবে কী চলবে না

হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান মুসলমান এবং ধর্মমুক্ত মানুষ সবাই আমরা পালন করতাম পয়লা বৈশাখ। বাংলা গান গাইতাম, বাঙালি খাবার খেতাম। বৈশাখি মেলায় গিয়ে দা-বটি, শিল নোড়া, বেলান পিঁড়ি, হাঁড়িকুড়ি, মুড়ি-মুড়কি, খই-খেলনা, মাটির পুতুল-টুতুল আর বাঁশি বেলুন কিনে আনতাম। বিকেলে বাবার হাত ধরে জুয়েলারির দোকানে-দোকানে গিয়ে হালখাতার মণ্ডা-মিঠাই খাওয়া ছিল আমাদের পয়লা বৈশাখ।

ঢাকার রমনায় ছায়ানটের গান, ইলিশ-পান্তা খাওয়া বা রাস্তায় মঙ্গল শোভাযাত্রা নিতান্তই নতুন ট্রাডিশান, বাঙালি এলিট শ্রেণি ওভাবেই কয়েক দশক আগে পয়লা বৈশাখের আধুনিকীকরণ করেছে। আমি দুটো উৎসবই দেখেছি, গ্রামের এবং শহরের উৎসব, পুরোনো এবং নতুন উৎসব। দুটোই জরুরি।

বেশ কয়েকবছর যাবৎ খবর পাচ্ছি, বাংলাদেশের ধর্মান্ধ মৌলবাদীগোষ্ঠী ঘোষণা করেছে তারা পয়লা বৈশাখের কোনও উৎসব অনুষ্ঠান চায় না। ভালো কথা, যারা চায় না তারা উৎযাপন না করুক, যারা চায় তারা করুক। এরপর শুনি, তারা নিজেরা তো উৎযাপন করবেই না, তারা কাউকেই উৎযাপন করতে দেবে না। এ কেমন কথা! বাংলাদেশ তো জানতাম গণতান্ত্রিক দেশ। আমি একা বলে না হয় আমাকে দেশ থেকে তাড়িয়েছে, পয়লা বৈশাখ পালন করছে লক্ষ লক্ষ মানুষ। লক্ষ লক্ষ মানুষের সংস্কৃতি গুটিকয় মৌলবাদীর হুমকির সামনে মুখ থুবড়ে পড়ে থাকবে? গুটিকতক হয়তো এখন আর গুটিকতক নেই।

ধর্মান্ধ মৌলবাদীরা বাংলা সংস্কৃতি পছন্দ করে না, তাদের পছন্দ ইসলামি সংস্কৃতি, তারা বাংলা সংস্কৃতিকে বলছে হিন্দু সংস্কৃতি। হিন্দু সংস্কৃতি বলে দোষ দিলে হিন্দু বিদ্বেষী মুসলমানরা পয়লা বৈশাখ ত্যাগ করবে। করছেও হয়তো। তারা আজ যে করেই হোক আরব দেশের কালচার আনবে বাংলাদেশে! সে কারণেই হিজাব পরাচ্ছে মেয়েদের। তারা জানে হিজাব কখনও হিজাবে থেমে থাকবে না। হাঁটিহাঁটি পা-পা করে হিজাব যাবে বোরখার দিকে।

সৌদি আরবে সব মেয়েরই বোরখা পরা বাধ্যতামূলক। আপাদমস্তক বোরখায় ঢাকা মেয়েরাও কিন্তু ধর্মীয় পুলিশের চাবুক থেকে রেহাই পায় না। রাস্তাঘাটে, মাঠে-ময়দানে ধর্মীয় পুলিশরা কোনও মেয়ের কপালে দু’একটা মাথার চুল কোনও ফাঁক-ফোকর দিয়ে অসাবধানে কখনও বেরিয়ে এলো কি না দেখার জন্য টহল দেয়। বেরোলেই চাবুক।

তাহলে ঢাকা শহরে পয়লা বৈশাখের ভিড়ে ওরকম ‘ধর্মীয় পুলিশ’ মোতায়েন করেছিল তারা, যারা বাংলাদেশে আরব দেশের কালচার আনতে চাইছে! শাড়ি-পরা যে মেয়েদের নাভি দেখা যায়, ঝুঁকলেই যে মেয়ের ক্লিভেজ শো করে, তাদের তারা শাস্তি দিয়েছে। এ নিতান্তই মহড়া। হাঁটিহাঁটি পা-পা করে ধর্মীয় পুলিশরা যাচ্ছে সেই ভয়ঙ্কর দিনের দিকে, যে দিন তারা বোরখা পরা মেয়েদেরও কপালে চুল দেখা গেলে পেটাবে।

অলরেডি ধর্মান্ধ জল্লাদ বেরিয়ে গেছে রাস্তায়। আরব দেশের জল্লাদরা যেমন পাবলিক প্লেসে তলোয়ার দিয়ে অপরাধীদের মুণ্ডু এক কোপে ফেলে দেয়, তেমনি বাংলাদেশের ধর্মান্ধ জল্লাদরাও মানুষের মুণ্ডু ফেলছে। তবে এক কোপে না ফেলতে পারলেও কয়েক কোপের দরকার পড়ছে। রাজীব, অভিজিৎ, বাবুদের ওপর দেশি জল্লাদরা মহড়া চালিয়েছে। হাঁটিহাঁটি পা-পা করে সেই দিনের দিকে তারা যাচ্ছে, যে দিন চাপাতি-টাপাতির ঝামেলা না করে ইসলামি মতেই বৈধ তরবারি হাতে নেবে, সরকারি আদেশে এক একটা বৈধ কোপে বিধর্মী , বুদ্ধিজীবি আর মুক্তমনা লেখক-ব্লগারদের মুণ্ডু ফেলবে।

হাঁটিহাঁটি পা-পা করে? মাঝে মাঝে মনে হয় বিশাল-বিশাল লম্ফ দিয়েই যাচ্ছে। খুব দ্রুতই যাচ্ছে।

আমি জানি না বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ কী। বাংলাদেশ কি সৌদি আরব হতে যাচ্ছে, পাকিস্তান হতে যাচ্ছে, নাকি যে বাংলাদেশের স্বপ্ন আমরা এককালে দেখেছিলাম, বাংলাদেশ হতে যাচ্ছে সেই বাংলাদেশ? বাংলাদেশ তার বাহাত্তরের সংবিধানে ফিরবে, বাংলাদেশের কোনও রাষ্ট্রধর্ম থাকবে না, কোনও একটি নির্দিষ্ট ধর্ম বাকি ধর্মের মাথার ওপর বসে ছড়ি ঘোরাবে না, কাউকে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক করবে না বাংলাদেশ, বাংলাদেশে ধর্মীয় মৌলবাদের কোনও স্থান থাকবে না– এরকম বাংলাদেশ আজকাল আমার মনে হয় অসম্ভব তৈরি হওয়া। বাহান্নোতে যে বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিলাম, উনসত্তরে যে বাংলাদেশ গড়তে চেয়েছিলাম, একাত্তরে যে বাংলাদেশ গড়বো বলে ঘর ছেড়েছিলাম, সেই বাংলাদেশকে গড়ার সুযোগ আমরা হাতে পেয়েও কাজে লাগাইনি, একে নষ্ট করে ফেলেছি, একে হায়েনার মুখে জেনে-শুনে ছুড়ে দিয়েছি। জানি দেশ আর দেশ নেই, তারপরও শাহবাগ আন্দোলনের আর পয়লা বৈশাখের বিশাল জনস্রোত দেখে আশা জাগে। তাহলে হয়তো হায়েনার মুখ থেকে ছিনিয়ে এনে ক্ষত-বিক্ষত রক্তাক্ত দেশটাকে শুশ্রুষা করে আবার সেই স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়তে পারি। ত্রিসীমানা থেকে আগে দূর করতে হবে হায়েনাকে।

পেণ্ডুলামের মতো দুলি আমি আশা আর নিরাশায়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *