০৭. আমরা এমনি এসে ভেসে যাই

অবকাশ থেকে খুব দূরে নয় মহাকালি ইশকুল। ইয়াসমিন হেঁটেই চলে যায় ওখানে শুক্রবারে। ছুটির দিন ইশকুলে আনন্দধ্বনির গানের ইশকুল বসে, সকলে সমস্বরে রবীন্দ্রসঙ্গীত গায়। ছোট বড় যে কোনও বয়সের মানুষ, কারও জন্য না নেই গানের ইশকুলে। পাঁচ বছর বয়সী আছে, আবার পঁচাত্তরও আছে। আমার খুব আনন্দ হয় দেখতে যে ইয়াসমিন চমৎকার রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইছে। আমার খুব আনন্দ হয় দেখে যে ও চমৎকার কবিতা আবৃত্তি করে, আমার কাছ থেকে তালিম নিয়ে আমাকে অনেক আগেই ছাড়িয়ে গেছে। সকাল কবিতা পরিষদে এখন ইয়াসমিনই সবচেয়ে ভাল আবৃত্তিশিল্পী। আমার অহংকার হয় ইয়াসমিনের জন্য। ও খুব ভাল একজন রবীন্দ্রসঙ্গীতশিল্পী হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলবে, আমি ওকে শান্তিনিকেতন পাঠাবো গান শিখতে, এরকম একটি তিরতির নীলাভ স্বপ্নের জলে আমি রাজহাঁসের মত সাঁতার কাটি। ইয়াসমিন আমার স্বপ্নের কথা জানে। নিজের জীবনের চেয়ে ইয়াসমিনের জীবনটিকে সুন্দর সুচারু করে তৈরি করতে যা কিছুৃ প্রয়োজন, আমি এক পায়ে দাঁড়িয়ে আছি করার জন্য। পরিবার পরিকল্পনা আপিসে কাজ তেমন কিছু নেই আমার, বাড়িতেই বেশি কাটে সময়, ইয়াসমিনই হয়ে ওঠে আমার সবচেয়ে দীর্ঘক্ষণের সঙ্গী, সবচেয়ে বড় বন্ধু। কেবল বাড়িতে নয়, বাড়ির বাইরে গেলেও ইয়াসমিন। ওকে সঙ্গে নিয়ে শহর ঘুরে বেড়ানো, ময়মনসিংহ অসহ্য হয়ে উঠলে ঢাকায় সুহৃদকে দেখতে চলে যাওয়া, সাহিত্য আর সংস্কৃতি প্রাঙ্গণে কিছু হাঁটাহাঁটি করে সময় কাটিয়ে একসময় গীতার আচরণে অতিষ্ঠ হয়ে আবার অবকাশে ফেরা। আমাদের এই বন্ধুত্বের মধ্যে অলক্ষ্যে এক সীমানা থাকে। আমরা কেউই ভুলেও এই সীমানা পার হই না। আমি যেমন কোনওদিন ইয়াসমিনকে বলিনি আমি কেন রুদ্রকে ছেড়ে এসেছি। ইয়াসমিনও বলে না হঠাৎ হঠাৎ ও কেন দেরি করে বাড়ি ফেরে। শুদ্ধ জীবন যাপন করতে গিয়ে কোনও অশ্লীলতাকে অন্তত দুজনের মধ্যে আমরা ঠাঁই দিই না। কিন্তু অশ্লীলতার সংজ্ঞা ইয়াসমিনের কাছে সম্ভবত আরও বেশি সংকীর্ণ, তাই সে ক্লাসের দুটো ছেলের সঙ্গে আড্ডা দিয়ে এসে আমাকে বলে বান্ধবী রিংকুর বাড়িতে গিয়েছিল। দুটো ছেলের সঙ্গে ক্লাসের পরে দুটো কথা বললে শুদ্ধতা কিছু কমে যায় না, কিন্তু আমি যদি ভুল ব্যাখ্যা করি সে আড্ডার, আমি যদি পছন্দ না করি, আমি যদি রুষ্ট হই, তাই ও গোপন রাখে। আমি যে ওকে ওর কোনও ছেলে বন্ধুর সঙ্গে মিশতে দিই না, তা নয়। ওর ছেলেবন্ধুরা আসে অবকাশে, ওদের সঙ্গে বসে ও গল্প করে। আমিও বসে গল্প করি। এত কাছের মানুষ আমি ওর অথচ এই দূরত্বটুকু কিছুতেই ডিঙোতে পারে না। আমাকে ভাল যেমন বাসে ও, ভয়ও তেমন পায়। ও ক্রমাগত আমার বন্ধুদের সঙ্গে মিশতে মিশতে, আমার পরমর্শ মত আমার পছন্দ করা কবিতা আবৃত্তি করতে করতে, আমি যে গান পছন্দ করি, যে জীবন পছন্দ করি, সেই গান গাইতে গাইতে, সেই জীবনে নিজেকে অভ্যস্ত করতে করতে আমি বুঝি না যে ও হাঁপিয়ে উঠছে। আমি বুঝি না যে ওর ভেতরে নিজের অস্তিত্বহীনতা দেখা দিচ্ছে। আমার মান সম্মান, যশ, প্রতিপত্তি যত অল্পই হোক, তা নিয়ে যে আমি যেমন ইচ্ছে বাঁচি, আর ওর যে আমার ওপর সম্পূর্ণ নির্ভর করতে হয়, ওর নিজের স্বাধীনতা যে আমার ইচ্ছের কাছে ক্ষয়ে ক্ষয়ে যাচ্ছে, তা অনুভব করে যে ওর ভেতরে একটি নিঃসঙ্গতা জন্ম নিচ্ছে, আমার বোঝা হয় না। আমার সৌন্দর্য আর আমার বিস্তৃত শিল্পিত ভূবন ও সারাক্ষণই দেখছে আর ওকে আমার এই ভূবনে টেনে এনে আমি রানী হয়ে বসে থেকে বুঝি না ও যে নিরীহ একটি প্রজার চরিত্রে কেবল। প্রজাটিকে আমি ভালবাসি, ওকে যা আমার মনে হয় যে ওর প্রয়োজন উদারহস্তে দান করি কিন্তু ওর নিঃসঙ্গতাকে টের পাই না। আমি যে ওকে আর দশটা মেয়েমানুষের মত লেখাপড়া শেষ করে যাকে তাকে বিয়ে করে যে কোনও গৃহবধু হতে দিতে চাইছি না, আমি যে ওকে ওর স্বকীয়তা, ওর নিজস্ব সৌন্দর্য শিল্প নিয়ে বিকশিত হওয়ার জন্য আলোকিত হওয়ার জন্য বিষম চাইছি তা বোঝে ও, বুঝেও হীনমন্যতায় ভোগে, আমার জানা হয় না যে ভোগে। এত কাছে থেকেও, এক বিছানায় দুজন ঘুমিয়েও ওর ক্ষত আমার দেখা হয় না। অবকাশে বাবার হিংস্রতা, দাদা আর তাঁর বউএর স্বার্থপরতা, মার উদাসীনতা সব কিছু থেকে ইয়াসমিনকে বাঁচিয়ে যে একটি সুস্থ সুন্দর পরিবেশ দিতে চাইছিলাম, তা আমি জানি না যে ব্যর্থ হচ্ছে।

ইয়াসমিন এক রাতে বাড়ি ফেরে না। রাত গভীর হতে থাকে, বাড়ি ফেরে না। শহরে ওর যত বন্ধু বান্ধবী আছে সবার বাড়িতে গিয়ে খুঁজি, না ও নেই। ওর চেনা পরিচিত কারও বাড়িতেই ও নেই। আত্মীয়দের বাড়িতেও খুঁজি, নেই। রাত পার হয়, আমি আর মা নির্ঘুম রাত পার করি। বাবা সারারাতই পাঁয়চারি করেন ঘরে। কোথায় হারাবে মেয়ে? অন্যদিনের মত কলেজে গেছে, কলেজ থেকে দুপুরে না হোক বিকেলে বাড়ি ফেরে, সেখান বিকেল পেরিয়ে রাত পেরিয়ে ভোর হতে যাচ্ছে, ইয়াসমিনের কোনও খবর নেই। আশঙ্কায় আমি নীল হয়ে থাকি। মার দুচোখ বেয়ে অবিরল জলের ধারা, তিনি মেঝেয় জায়নামাজ বিছিয়ে নামাজের পর নামাজ পড়ে যাচ্ছেন আর আল্লাহর কাছে মেয়েকে যেখানেই রাখেন হেফাজতে রাখার অনুরোধ জানাচ্ছেন। ভোরবেলা থেকে কালো ফটকের সামনে বসে আছি, সকাল কেটে যায়, দুপুর পার হয়, ইয়াসমিন ফেরে না। বাবা বার বার চেম্বার থেকে ফোন করছেন বাড়িতে ইয়াসমিন ফিরেছে কি না জানতে। মা বুড়া পীরের মাজারে গিয়ে কিছু একটা মানত করে আসেন। আমার শ্বাস কষ্ট হতে থাকে দুর্ভাবনায়। আমার আর চিন্তা করার শক্তি থাকে না কোথায় ও যেতে পারে। রাত যখন নেমে আসে, রাত নেমে রাত বাড়তে থাকে, তখন খবর আসে ইয়াসমিন সানকিপাড়ায়, ওর ক্লাসে পড়ে ছেলে মিলনের বাড়িতে। খবরটি ঈশান চক্রবর্তী রোডে থাকে জাহাঙ্গীর নামের ইয়াসমিনের চেনা একটি ছেলে দেয়। সঙ্গে সঙ্গে দাদাকে নিয়ে আমি ছুটি সানকিপাড়ায় ওকে নিয়ে আসতে। একটি বিছানায় হাঁটুতে মাথা গুঁজে ও বসে ছিল। কি হয়েছে ইয়াসমিনের! আমি দৌড়ে গিয়ে ওর হাত ধরলে ও এক ঝটকায় ওর হাত ছাড়িয়ে নেয়। বলে ‘ছুঁয়ো না আমারে!’

ছোঁবো না, হয়েছে কী! কেউ কিছু বলেছে! রাগ কেন!

‘চল বাসায় চল।’

‘না।’

এ কেমন উত্তর!

ইয়াসমিনের বক্তব্য মিলনের বড় ভাই মানু যা জানায় তা হল ইয়াসমিন মিলনকে বিয়ে করতে চায়। এক্ষুনি যেন আমরা ওকে মিলনের সঙ্গে বিয়ে দিই। হতবাক আমি জীবনে আর কখনও এভাবে হইনি! আমি বাকরুদ্ধ বসে থাকি। মিলনের সঙ্গে কোনওরকম প্রেমের সম্পর্ক ওর নেই এ ব্যপারে আমি নিশ্চিত। কিন্তু কী কারণে বিয়ের মত একটি অশালীন শব্দ ইয়াসমিন উচ্চারণ করতে পারে আর এমন অসভ্যের মত বিয়ের আবদার করছে আমি বুঝতে পারি না। ইয়াসমিন ঘোষণা দিয়ে দেয়, ও আর অবকাশে ফিরবে না। ফিরবে না তো ফিরবেই না। টেনে হিঁচড়ে তো নেওয়া সম্ভবই নয়, আদর করে বুঝিয়েও কোনও কাজ হয় না। শরীর লোহার মত শক্ত করে রেখেছে, মনটিকেও জানি না কি দিয়ে পিটিয়ে লোহা বানিয়ে নিয়েছে। ওর সব কিছু বড় অদ্ভুত লাগে। আজ ওর কাছে আমি বা দাদা কেউ নই, মিলন সারাক্ষণই বাইরে দাঁড়িয়ে ছিল মাথা নিচু করে, যখন ভেতরের ঘরে এই নাটক ঘটছিল। ইয়াসমিন বেরিয়ে ছিল গতকাল জামা পাজামা পরে, এখন পরে আছে নীল একটি শাড়ি। শত ভেবেও আমার মাথায় কিছু ঢোকে না কি ঘটেছে, কি কারণে ও এমন অস্বাভাবিক আচরণ করছে। মানুর কাছে জিজ্ঞেস করে কোনও উত্তর পাই না। দাদা ইয়াসমিনকে বুঝিয়ে বললেন, ‘বিয়ে তো এভাবে হয় না, এখন বাড়ি চল, পরে বিয়ের ব্যবস্থা হবে।’ আমিও বললাম, ‘এই মিলনকেই যদি তোর বিয়ে করতে হয়, ঠিক আছে লেখাপড়া শেষ কর, পরে ওকেই বিয়ে কর।’ ইয়াসমিন তিন দিন সময় দেয়, তিন দিনের মধ্যেই যেন ওর বিয়ের ব্যবস্থা করা হয় মিলনের সঙ্গে। আমি হু হু করে কাঁদলাম বাড়ি ভর্তি লোকের সামনে। ইয়াসমিন আমার কান্না দেখেও মত পরিবর্তন করেনি। মধ্যরাত পার হয়ে যায় কেবল বিয়ের ব্যপারটির মিমাংসা করতে। ইয়াসমিনের ঘোষণা আমার নিজের কানে শোনা হয় না, ও মিলনের ভাই বোনের কাছে বলেছে ওর যা বলার। ওরাই এখন আপন ওর, যা কিছু ও জানাতে চাইছে, জানাচ্ছে ওদের দিয়ে। আমাকে সরাসরি ও কিছু বলে না। ওর কেন হঠাৎ আমার ওপর এই রাগ, আমি বুঝে পাই না। কী এমন ঘটেছে, আমি কী করেছি যে আমার ওপর এই রাগ! রাতে আমার আর অবকাশে ফেরা হল না। দাদা ফিরে গেলেন। আমি রাতটুকু ওর পাশে শুয়ে আরও একটি নির্ঘুম রাত কাটালাম। রাতে যতবারই চুপি চুপি জিজ্ঞেস করেছি কি ঘটেছে যেন আমাকে বলে ও, যতবারই আমি ওর কাঁধে বা হাতে আলতো করে হাত রেখেছি, ও আমার হাত সরিয়ে দিয়েছে শক্ত হাতে। ও নিজেও ঘুমোয়নি। নাটকটির পেছনে কোনও রহস্য আছে, আমি নিশ্চিত। পরদিন সকালে ইয়াসমিনকে অবকাশে ফিরিয়ে নিয়ে আসি কথা দিয়ে যে বিয়ে মিলনের সঙ্গেই ওর হবে, আজ না হয় কাল, কাল না হয় পরশু। এ ছাড়া আর কোনও উপায় ছিল না ওকে বাড়ি নিয়ে আসার। সারা পথ ও আমার সঙ্গে কোনও কথা বলে না। আমার চোখের দিকে তাকায় না। এরকম পরদিনও। সারাদিন শুয়ে থাকে দেয়ালের দিকে মুখ করে। দাদা বাড়ি এলে চেঁচিয়ে নির্লজ্জের মত নিজের বিয়ের কথাটি স্মরণ করিয়ে দেয়। আমার সহস্র প্রশ্নের একটি উত্তরও ও দেয় না। বলে না কি হয়েছে ওর, যে রাতে বাড়ি ফেরেনি, কোথায় ছিল সে রাতে, বলে না। কী এমন ঘটেছে যে মিলনকে ওর তিনদিনের মধ্যেই বিয়ে করতে হবে, বলে না। রহস্যের কোনও কূল কিনারা আমি পাই না। বাড়ির কেউই পায় না। পরে, অনেক বছর পর যখন নিজের স্বামী সন্তান নিয়ে সংসার করছে ইয়াসমিন, যখন ওর সেই বয়সের আড়ষ্টতাগুলো দূর হয়েছে, বলেছে কি ঘটেছিল সে রাতে। একই ক্লাসে পড়া বন্ধু-মতো ছেলে মিলন তার বড় ভাইয়ের মোটর সাইকেল চালিয়ে কলেজে গিয়েছিল। ক্লাস শেষে মিলন ইয়াসমিনকে আমন্ত্রণ জানায় মধুপুরে বেড়াতে যাওয়ার। ইয়াসমিন না করেনি। মোটর সাইকেলের পেছনে বসে দূরে কোথাও বেড়াতে যাওয়ার ব্যপারটি স্পষ্টতই লোভনীয়। মধুপুরে বোটানির ছাত্রছাত্রী গাছপালা দেখতে দেখতে জঙ্গলে হাঁটে। কোন গাছের কি নাম, কোন পাতায় কি অসুখ তা বলতে বলতে, কিছু পাতা আর শেকড় তুলে জমাতে জমাতে মধুপুর কটেজের দিকে হেঁটে যেতে থাকে যেখানে মোটর সাইকেলটি দাঁড় করানো। কটেজ পর্যন্ত পৌঁছোয়নি, তখনই একটি পেটমোটা পুলিশ এসে দুজনকে থামতে বলে। পেটমোটা ওদের দিকে বাঁকা হাসি ছুঁড়ে বলল, ‘কি করস তরা এইখানে!’ ওরা জানালো যে ওরা কলেজে পড়ে, কলেজ থেকে এখানে এসেছে ঘুরে ঘুরে গাছপালা দেখতে। পেটমোটা বিকট হাসি হাসে। এদিক ওদিক দেখে নিয়ে কেউ আসছে কি না, খেঁকিয়ে ওঠে, ‘পাঁচ হাজার টাকা দে।’ পাঁচ হাজার টাকা কেন দিতে হবে এ কথাটি জিজ্ঞেস করার আগেই পেটমোটা বলে, ‘জঙ্গলে অবৈধ কাজ করতে আইছস, টাকা না দিলে এইখান থেইকা যাইতে পারবি না।’ ওরা অস্বীকার করল, কোনও রকম অবৈধ কাজ করার উদ্দেশে ওরা আসেনি। পেটমোটা কান দেয় না ওদের কথায়। ইয়াসমিনের দিকে তাকিয়ে চোখ টিপে বলে, ‘ছেড়ি তো বাজারের ছেড়ি, দেইখ্যাই তো বুঝা যাইতাছে।’ না, দেখে তা মনে না হলেও পেটমোটা বলল তা। মিলন বলল তার হাতে টাকা নেই, টাকা নিয়ে আসতে তার শহরে যেতে হবে। পেটমোটা খপ করে ইয়াসমিনের হাত ধরে মিলনকে বলে, ‘যা শহরে, তুই যা, এইটারে রাইখা যা।’ইয়াসমিন পেটমোটার খসখসে শক্ত হাত থেকে নিজেকে ছাড়াতে চেয়ে ব্যর্থ হয়। মিলনের দিকে করুণ চোখে তাকিয়ে বলে, ‘মিলন তুমি যাইও নাঞ্চ। করুণ চোখে তাকিয়ে অনেকে অনেক কিছু আবদার করে, কিন্তু সেই আবদার সবাই রাখে না। নিজের কথা ভাবে। চাচা আপন প্রাণ বাঁচা বলে যে একটি কথা আছে, তা মিলন জানে না তা নয়, জানে। মিলনের ওপর এখন সম্পূর্ণ নির্ভর করছে সে ইয়াসমিনকে এই জঙ্গলে এক বদমাশ পুলিশের হাতে ছেড়ে দিয়ে চলে যাবে কী না। মিলন চলে গেলে টাকা নিয়ে সে ফিরুক না ফিরুক, পুলিশ ইয়াসমিনকে অক্ষত অবস্থায় রাখবে না। হয়ত ওকে ধর্ষণ করে ফেলে রেখে উধাও হয়ে যাবে জঙ্গলে। লজ্জায় শরমে আত্মহত্যা ছাড়া আর কোনও পথ থাকবে না ওর। চোখ কান নাক মুখ বন্ধ করে এরকমই ভাবছে ইয়াসমিন। মিলনের একটি হাত মোটর সাইকেলে, আরেকটি হাত কোমরে, কোমরের হাতটি যদি মোটর সাইকেলের হাতল স্পর্শ করে, যদি করে এই ভয়ে ইয়াসমিন চোখ খোলে না। আশঙ্কায় কাঁপছে ও ভেতরে, বধির হতে চাইছে যেন ওকে শুনতে না হয় মোটর সাইকেল স্টার্ট হওয়ার কোনও ভয়ংকর শব্দ। ইয়াসমিনের অনুরোধ মিলন না রাখতেও পারত। মোটর সাইকেলে চড়ে দিব্যি চলে যেতে পারত পেছনে কি হবে না হবে তার কিছুই না ভেবে, পুলিশ তো তাকে ছেড়েই দিয়েছে। হ্যাঁ মিলন চলে যেতে পারত, ইয়াসমিন তার কোনও প্রেমিকা নয় যে ঝাঁপিয়ে পড়বে বিপদ থেকে ওকে উদ্ধার করতে। কিন্তু মিলন যায়নি। না সে যায়নি। পুলিশকে বলেছে, ‘মোটর সাইকেল রাইখা দেন, আমাদেরে যাইতে দেন, শহর থেইকা টাকা নিয়া আসি।’ নাহ, মোটর সাইকেল পুলিশ রাখবে না, রাখবে ইয়াসমিনকে। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হলে সে যা ইচ্ছে তাই করবে ওকে। কারও অনুমান করতে অসুবিধে হয় না কী করবে। ইয়াসমিন ভয়ে কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। পুলিশের মুহূর্মহু আদেশেও মিলন জিম্মি হিসেবে একা ইয়াসমিনকে রাখতে দেয়নি। মিলন যখন স্পষ্ট জানিয়ে দেয় যে সে যাবে না, হারিয়ে যেতে থাকা জীবনটি ইয়াসমিন হাতে পেল, কৃতজ্ঞতায় সে ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল। তারপর সত্যি সত্যি যখন একসময় সন্ধে নামল, ঝুপঝুপ করে অন্ধকার ঝরে জঙ্গল কালো হয়ে গেল, পুলিশ ওদের দুটিকে নিয়ে বনবিভাগের এক কর্মকর্তার বাড়িতে ঢুকিয়ে বলে এল, কাল সকালে গুণে গুণে পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে যেন ওরা বেরোয়। মোটর সাইকেল জমা রইল পুলিশের কাছে। সেই বাড়িতে ইয়াসমিনের নাম ঠিকানা যখন জিজ্ঞেস করা হয়, বিবর্ণ মুখে ইয়াসমিন বাবার নাম আবদুর রফিক, পেশা ব্যবসা, ঠিকানা কাঁচিঝুলি বলে নিজের আসল পরিচয় লুকিয়ে রাখে দুহাতের দু মুঠির মধ্যে। রাখে কারণ নিজের বাবা স্বনামধন্য ডাক্তার রজব আলীর মুখে ও চুন কালি দিতে চায় না। মেয়ে রাতে বাড়ি ফেরেনি, কোনও এক ছেলেসহ পুলিশের হাতে ধরা পড়েছে, এর চেয়ে বড় কলঙ্ক একটি মেয়ের জীবনে আর কী হতে পারে! ইয়াসমিন সারারাত ঘুমোয় না। ওকে ঘুমোতে দেওয়া হয়েছে বাচ্চাকাচ্চাদের ঘরে। সারারাত বারান্দার একটি ঘরে মিলনও না ঘুমিয়ে কাটায়। মিলন কর্মকর্তার বাড়ি থেকে এক বন্ধুকে ফোন করে দিয়েছে যেন খুব সকালে পাঁচ হাজার টাকা যোগাড় করে মধুপুরের বনবিভাগের কর্তার বাড়িতে আসে। সকালে বন্ধু টাকা নিয়ে এলে সেই টাকা পুলিশকে দিয়ে মোটর সাইকেল ফেরত নিয়ে দুজনে ফেরে শহরে। শহরে তো ফিরল, এখন কী হবে! কলঙ্ক যাবে কোথায়! এক রাতের কলঙ্ক মোচন করবে ইয়াসমিন কী করে! মিলন পরামর্শ দেয়, এই মুহূর্তে বিয়ে ছাড়া এই কলঙ্ক থেকে মুক্তির কোনও উপায় নেই। ইয়াসমিন রাজি হয় না। অবকাশের কাছেই ওর চেনা সেই জাহাঙ্গীর ছেলেটির বাড়িতে উঠল, সারাদিন ভাবল অবকাশে ফিরবে কী ফিরবে না। ফিরলে সকলে ঘিরে ধরবে, জিজ্ঞেস করবে কাল রাতে কোথায় ছিল ও। কী উত্তর দেবে! ও তো নানির বাড়ি ছিল না, কোনও খালার বাড়িতে ছিল না, কোনও বান্ধবীর বাড়িতে ছিল না। ছিল না যে এসব কোনও বাড়িতে, তা তো অবকাশের সকলে কাল রাতেই জেনে গেছে নিশ্চয়ই। জাহাঙ্গীরের বাড়ি থেকে অবকাশের কালো ফটকের সামনে এসে সন্ধেবেলায় অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকেছে। ঢুকবে কি ঢুকবে না করেছে। অপেক্ষা করেছে, কিসের অপেক্ষা ও নিজেই জানে না। কোনও আলো এসে ওর রাতের কলঙ্ক মোচন করার অপেক্ষা! কোনও জাদু বলে জীবনকে একটি রাত পিছিয়ে নিতে পারার অপেক্ষা! না, কিছুই গতরাতের নিখোঁজ হওয়া মেয়ের কলঙ্ক মোচন করে না। এরপর নিজের ওপর ধিককার ওকে মিলনের বাড়িতে নিয়ে নাটকটি ঘটায়। মুখ দেখাতে তখনও ও পারেনি, তাই হাঁটুতেই গোঁজা ছিল মুখ। নাটকের যবনিকা পতন হওয়ার পর অবকাশে ফিরেছে বটে, গোঁজা মুখটি তুলেছে বটে, কিন্তু চোখ কারও চোখে পড়তে দেয় না, চোখ হয় দেওয়ালে, নয়ত কড়িকাঠে। ও যেন এ বাড়ির কেউ নয় আর, সেই আগের ইয়াসমিন ও নয়, এ বাড়ির কণিষ্ঠা কন্যা ও নয় আর। দেখে এত মায়া হয় আমার, মায়া হয় আবার রাগও হয়। শত জিজ্ঞাসাতেও যখন ও মুখ খোলে না, বলে না কী ঘটেছে যে এমন হুট করে বিয়ে করতে হবে ওর, আমি দরজার চৌকাঠে বসে সন্ধের আঁধার আঁধার উঠোনের দিকে তাকিয়ে, যেন বিছানায় শুয়ে থাকা ও শুনতে পায়, মুখ এদিকে না ফেরালেও, বলি ‘জীবন কিন্তু একটাই, যদি কোনও দুর্ঘটনা ঘইটা থাকে ওই রাত্রে, তাইলে কী হইছে এমন! মানুষের জীবনে কত দুর্ঘটনাই ত ঘটে, এইল্লিগা বিয়া করতে হইব? তর সাথে কী সম্পর্ক মিলনের? যদি ওর সাথে গোপনে গোপনে প্রেম কইরা থাকস, যদি ওরে ছাড়া না বাচস, তাইলে যা, বিয়া কর। বিয়া করার শখ হইছে বিয়া কর। কিন্তু একটা জিনিস মরে রাখিস, বিয়া করার সিদ্ধান্ত হুট কইরা লওয়া বালা না। নিজে আগে লেখাপড়া শেষ কইরা চাকরি কর। তারপর ত বিয়া। নিজের পায়ে দাঁড়া আগে। কারও ওপর ডিপেণ্ডেন্ট হইস না। বোটানিতে মাস্টার্স কর। পিএইচডি কর। টিচার হ। তুই তো এগ্রিকালচার ইনিভার্সিটির টিচার হইতে পারবি। বিয়া করার শখ হইছে, তাইলে মিলন কেন? ও কী জানে? কী পারে? শুদ্ধ কইরা ত একটা বাক্যও কইতে পারে না। তার ওপর মানুর ভাই ও। অমন শয়তানের ভাই আর কত ভাল হইব! কত ভাল ভাল ছেলেরা আসে এই বাড়িতে। তাদেরে কাউরে পছন্দ কর। আমার অনেক ডাক্তার বন্ধুই তো তরে বিয়া করার সুযোগ পাইলে ধন্য হইয়া যাইব।’

আমার যে ভয়টি ছিল যে মিলনের সঙ্গে ইয়াসমিনের বিয়ের ব্যবস্থা না করলে ভয়ংকর কোনও নাটক ও ঘটাবে অবকাশে, কিন্তু আমার সেই ভয় দূর করে দিয়ে দেখি ও হঠাৎ ঠিক আগের ইয়াসমিন হয়ে উঠল। বাড়িতে ওর বান্ধবীরা আসছে, বান্ধবীদের বাড়িতে ও যাচ্ছে। বিয়ে তো দূরের কথা, মিলনের ফোন এলে ও বলে দেয় ও কথা বলবে না। কথা অবশ্য একদিন বলল, কড়া কণ্ঠে বলে দিল, বাড়ি থেকে ওর বিয়ে ঠিক করা হয়েছে, মিলন যেন আর ফোন না করে। কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা থেকে রানা নামের দেখতে সুন্দর একটি ছেলে আসে ইয়াসমিনের কাছে। ছেলেটি ইয়াসমিনের বান্ধবী কৃষ্টির বন্ধু রাকার বড় ভাই। রানার সঙ্গে বৈঠকঘরে বসে অনেকক্ষণ গল্প করে ইয়াসমিন। দেখে স্বস্তি হয় আমার। স্বস্তি হয় এই জন্য যে মিলনকে বিয়ে করার পাগলামো ওর দূর হয়েছে, আর মিলনের চেয়ে রানা ছেলেটি দেখতে শুনতে বিদ্যায় বুদ্ধিতে অনেক ভাল। রানা ফোন করলে দীর্ঘক্ষণ মিহি সুরে কথা বলে ও। রানা মাঝে মাঝে নিজে গাড়ি চালিয়ে এ বাড়িতে আসে, বুক ফুলিয়ে গাড়ির গর্বে ইয়াসমিনকে নিয়ে বেরিয়ে যায় এদিক ওদিক বেড়াতে। যায় কিন্তু পেট্রোলের টাকাটি ইয়াসমিনের কাছ থেকে নেয়। রিক্সাভাড়াও মাঝে মাঝে ওর কাছ থেকে নেয়। ইয়াসমিন হঠাৎই একদিন এই টাকা-লোভী রানার সঙ্গে হতে যাওয়া প্রেমটি চুকিয়ে ফেলে। নিয়মিত কলেজে যায়, ক্লাস শেষ হলে বাড়ি ফেরে। সকাল কবিতা পরিষদের আবৃত্তি আর আনন্দধ্বনির গানের উৎসবে মেতে থাকে। ওর শখের জিনিসপাতি, এমনকি প্রয়োজনেরও, বাবা যা দেন না বা দিতে চান না, দিই আমি। মিলনের সঙ্গে এক রাতের হাওয়া হওয়ার কলঙ্কটি ধীরে ধীরে মলিন হয়ে গেছে। কিন্তু একটি জিনিস ইয়াসমিনের মনে হতে থাকে, তা হল, কেউ ওকে পছন্দ করে না। বাড়িতে আমার চেনা পরিচিত বা বন্ধু যারাই আসে, ডাক্তার বন্ধু, সাহিত্যিক বন্ধু, আমার রূপ আর গুণের দিকে তারা তাকিয়ে থাকে দুচোখ মেলে, কেউ তো ইয়াসমিনের দিকে একবার মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকায় না! এই মনে হওয়াটি নিয়ে ওর যে কষ্টটুকু ছিল তা কেটে যায়, যেদিন আতাউল করিম সফিক ওর দিকে তাকালো। সফিক আমার বয়সী, সুদর্শন যুবক, মাথার চুল থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত ভদ্রতা আর অমায়িকতা, একনিষ্ঠ সাহিত্যকর্মী। সাহিত্যসেবা করেছে বলে অয়চ্ছল জীবনের পথে পা বাড়ায়নি। লেখাপড়া শেষ করে বিসিএস পাশ করে সহকারী ম্যাজিস্ট্রেট হয়েছে। ইয়াসমিনের জন্য সফিকের আগ্রহ আমাকে আশ্বস্ত করে। আমি ঠিক ইয়াসমিনকে লেলিয়ে দেওয়া বলতে যা বোঝায় তা দিইনি, তবে সফিক এসে যখন ইয়াসমিনকে খোঁজে আমি ওকে ডেকে দিই, ও যখন সফিকের সামনে যাওয়ার আগে ভাল একটি জামা পরে বা চুল আঁচড়ায় বা লিপস্টিক দেয়, আমি ধমকে বলি না ‘সাজস কেন! সাজার কী হইল! যেমনে আছস, অমনে যা।’ যখন দুজন বসে গল্প করে, আমি বলি না, ‘অত বেশি গপ্প করার দরকার নাই।’ হঠাৎ করে আমি যেন খুব উদাসীন হয়ে যাই। যে ঘরে বসে ওরা গল্প করে, সে ঘর থেকে কোনও একটি কাজের ছুতোয় আমি অন্য ঘরে চলে যাই। কাউকে বলি ও ঘরে চা নাস্তা কিছু দিয়ে আসতে অথবা নিজেই ট্রে সাজিয়ে নিয়ে যাই। সফিক চলে গেলে জিজ্ঞেস করি, ‘কি কইল সফিক!’ ইয়াসমিন মিষ্টি হেসে বলে, ‘কয় আমারে নাকি খুব সুন্দর লাগতাছে।’

‘আর কী কয়?’

‘কয় চল একদিন কোথাও বেড়াতে যাই।’

একদিন যখন সফিক ইয়াসমিনকে নিয়ে বাইরে বেড়াতে যেতে চাইল, ইয়াসমিন লাজুক হেসে ঘটনাটি জানালে আমি বললাম, ‘তা যা না, বেড়াইয়া আয়।’ আমার অনুমতি ইয়াসমিনকে সফিকের সঙ্গে বাইরে পাঠায়। অনুমতি দিই কারণ মিলনের মত একটি গবেট ছেলেকে বিয়ে করার ওর আবদারটি এখনও মাঝে মাঝে ভয়াবহ দুঃস্বপ্নের মত আমাকে ধারালো দাঁত নখ বের করে আঁচড় বসায়। তা না হলে আমি তো ছিলামই অন্যরকম, যে আমি কখনও ভুলেও ভাবিনি যে ইয়াসমিন আর আমি সারাজীবন এক সঙ্গে থাকবো না কেবল গান আর কবিতা নিয়ে। বিয়ের মত দুর্ভাবনা কখনই আমার মাথার আশে পাশেই ভিড়তে সাহস পেত না না যদি না সেদিনের ওই নাটকটি না ঘটত। বিয়ে করলে প্রেম করে বিয়ে করা ভাল, কোনও দুর্ঘটনায় পড়ে বা কোনও কৃতজ্ঞতা প্রকাশের জন্য যেন সে বিয়ে না হয়। বাইরে থেকে ফিরে এলে ইয়াসমিনকে জিজ্ঞেস করি, ‘কই গেছিলি, কি কইল সফিক।’ ইয়াসমিন বলে ‘এগ্রিকালচারাল ইনিভার্সিটিতে নিয়া গেছিল।’ কি কইলর উত্তরে কাঁধ নেড়ে বলল, তেমন কিছু না। আমার জানার ইচ্ছে ছিল ‘তোমাকে ভালবাসি, চল আমরা বিয়ে করি’ এরকম কিছু একটা বলেছে কী না। সফিক সম্পর্কে জানতে চাইলে বাবা মাকে জানিয়ে দিয়েছি, ‘খুব ভাল ছেলে, এরকম ছেলে লাখে একজন। ছেলেডা ইয়াসমিনরে খুব পছন্দ করে।’ সাহিত্যিক এই গুণটি বাবা বা মার জন্য কোনও গুণ নয়। গুণ হল ভাল চাকরি করে ছেলে, সেটিই। কদিন পরই লক্ষ্য করি, সফিক ডাকলেও ইয়াসমিন আর কাছে যাচ্ছে না, আমার অনুরোধও ওকে সামান্য নড়াতে পারে না, আমি হাত ধরে টানতে নিলে আমার হাত থেকে নিজেকে সজোরে ছাড়িয়ে নিয়ে বলে, ‘ধুর আমারে ঠেইল্যো না তো! আমি যাইতাম না!’ কেন ও যাবে না সফিকের সামনে, কি ঘটেছে, ইয়াসমিন আমাকে কিচ্ছু জানায় না। পরে একদিন শুধু বলেছিল, ‘ব্যাডা শইলে হাত দিতে চায়।’

মানে? কান ঝাঁ ঝাঁ করে ওঠে আমার।

‘শইলে হাত দিয়ে চায় মানে!’

‘মানে আর কী!’

‘কী, হাত ধরতে চায়?’

‘হ।’

কানের ঝাঁ ঝাঁ কমতে থাকে। ‘হাত না হয় ধরলই। হাত ধরা তো এমন কিছু না।’ ইয়াসমিন সরে যায় সামনে থেকে। শরীর প্রসঙ্গে আমাদের কথপোকথন কখনও খুব এগোয় না কারণ একটি অদৃশ্য সুতোয় আমাদের ঠোঁটজোড়া বাঁধা। সেদিনের প্রশ্নের উত্তর হাত থেকে কোথাও প্রসারিত হয় না বা হতে চায় না।

ইয়াসমিন আমাকে বলে না সফিকের মত শিক্ষিত সজ্জন মূল্যবান রুচিবান সংস্কৃতিবান ছেলেকে এমন হেলা করছে কেন ও! অনেক অনেক বছর পর যখন স্বামী সন্তান নিয়ে সংসার করছে ইয়াসমিন তখন সফিকের প্রসঙ্গ উঠলে ও হেসেছে, হাসতে হাসতে বলেছে, দেবতার ভেতরের ভয়ংকর এক দানব দেখেছে ও। সেদিনের সেই অক্ষমতা আর কাউকে কিছু বোঝাতে না পারার অস্থিরতা ওকে যে যন্ত্রণা দিয়েছে, সেই যন্ত্রণার কথা মনে করে একটি কালো রেখা ফুটে উঠছিল ওর ফর্সা কপালে। ওর প্রতি সফিকের আগ্রহ ওকে অন্তত এইটুকু নিশ্চিতির উদ্ধার দিয়েছিল যে সফিকের সঙ্গে ওর বিয়ে হলে সংসারের সকলের মুখে হাসি ফুটবে, চুনকালির আশঙ্কা জন্মের মত দূর হবে। কিন্তু যখন সফিকের বলার কথা তোমাকে ভালবাসি, দুজনে কথা বলতে বলতে কোথাও কোনও খোলা বাগানে পাশাপাশি হাঁটার কথা, একসময় হাঁটতে হাঁটতে হাতে হাত রেখে নদীর ওপারের না ফুরোনো সবুজের দিকে তাকিয়ে আগামী দিনের স্বপ্নের কথা বলার কথা— তখন সফিক একটি খালি ঘরে ওকে নিয়ে হুড়োহুড়ি করে ওর বুক খামচে ধরতে চায়। কেবল তাই নয়, এরপর অবকাশ এক বিকেলে খালি পেয়ে ইয়াসমিনের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল সে, টেনে জানা খুলতে চেয়েছে, টেনে পায়জামা। ইয়াসমিন চিৎকার করে বারান্দায় ঘুমিয়ে থাকা সুফিকে জাগিয়ে তুলেছে, গালাগাল করে সফিককে বাড়ি থেকে বের করে শোবার ঘরের দরজা বন্ধ করে বালিশে মুখ গুঁজে জন্মের কান্না কেঁদেছে। কেঁদেছে ভাবতে ভাবতে যে কেউ ওকে সত্যিকার ভালবাসে না, কেবল এই শরীরটির ওপর সবার লোভ, আর কিছু নয়। এই শরীর খুব সস্তা শরীর। যার কিμছু নেই ভালবাসার, তার শরীর বুঝি হাত বাড়ালেই পাওয়া যায়। কবিতা লেখে ছেলে কাজল শাহনেওয়াজ, যার হোস্টেলের ঘরে সফিক ইয়াসমিনকে নিয়ে গিয়েছিল, সেই কাজল অবকাশে আমার সঙ্গে সাহিত্যের আলাপ করে চা বিস্কুট খেয়ে যাবার সময় ইয়াসমিনকে একদিন চোখ টিপে বলে গেছে আবার যেন ও একা তার হোস্টেলের ঘরে যায়। আবদুল করিমের কথাও ওর মনে পড়েছে। হাসিনার দুলাভাই আবদুল করিম অবকাশের ঘনিষ্ঠ আত্মীয় হয়ে উঠেছে, প্রায়ই বউ ছেলেমেয়ে নিয়ে বেড়াতে আসে, মা সবাইকে যত্ন করে খাওয়ান দাওয়ান, সেই হাতির মত দেখতে আবদুল করিম ইয়াসমিনকে একা পেয়ে ফিসফিসিয়ে বলেছে সপ্তাহে একবার যদি শোয় ও আবদুল করিমের সঙ্গে এক হাজার টাকা করে পাবে, তাহালে মাসে চার হাজার টাকা কামাই হবে ইয়াসমিনের। ব্যাটার স্পর্ধা দেখে ইয়াসমিন তাজ্জব হয়ে গিয়েছিল। তাজ্জব হয়েছে কিন্তু বলেনি আমাকে। বলেনি এইজন্য যে কেন আমার ওপর এই ঝঞ্ঝাট আসে না, কেন ওর ওপরই শুধু, এ যদি আমাকে বিষণ্ন করে, ভাবায়! যদি আমি ওকেই দোষী বলে ভাবি। অথবা এতে যদি আরও ও যে কুরূপা-নির্গুণ তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে, ওই শঙ্কায় সম্ভবত অথবা লজ্জায় ও বলেনি, অন্যের অন্যায় দেখে নিজেরই যে লজ্জা হয় সেই লজ্জায় অথবা বলেনি কারণ আমি যে ওকে শুদ্ধ সুন্দর মেয়ে বলে মনে করি, সেই মনে করাকে ধাককা দিয়ে নোংরা ডোবায় ফেলতে চায় না, আমি যে ওকে নিয়ে চমৎকার স্বপ্ন দেখছি, সেই স্বপ্ন ও গুঁড়ো করে দিতে চায় না, আমার আদরের আহলাদের আকাঙ্খার বোনটিকে যেমন আমি জানি চিনি ভালবাসি, তেমনই থাকতে চায়, আমার প্রিয় প্রিয় গানগুলি গাইতে চায়, আমার প্রিয় প্রিয় কবিতা আবৃত্তি করতে চায় ওর আশ্চর্য সুন্দর কণ্ঠে, ওকে নিয়ে আমার গৌরবের ওপর একতাল গোবর ফেলে দিতে চায় না। আমাকে ভালবাসে তাই ওর কোনও কষ্ট আমাকে দেখাতে চায় না যা দেখলে আমার কষ্ট হবে। আমার স্বপ্নকে গানে কবিতায় বাড়তে দেয়। আমার ইচ্ছের সুতোয় রঙিন ঘুড়ি বেঁধে দেয়। বেঁধে দিয়ে আড়ালে গিয়ে গোপনে চোখের জল মোছে।

মাস গড়াতে থাকে। জীবন গড়াতে থাকে জীবনের মত। ছোট খাটো সুখ দুঃখে বয়স বাড়তে থাকে অবকাশের। অবকাশের মানুষ তাদের সুখগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে দেয়, দুঃখগুলো একা একা গোপনে লালন করে। মার ডালিম গাছে ডালিম ধরেছে। মা খুশিতে বাগ বাগ করে বাড়ির সবাইকে খাওয়ালেন, একটি নিয়ে গেলেন নানির বাড়িতে ভাগ করে খাওয়াতে, সকলে খেয়ে বাহ বাহ করেছে মার গাছের ডালিমের। আনন্দে মা আরও দুটো ডালিম গাছের চারা এনে লাগালেন উঠোনে। মার আনন্দই দেখেছে সবাই, কেউ মার কষ্টগুলো দেখেনি। ইয়াসমিন অনার্স পরীক্ষায় খুব ভাল ফল করেছে। কলেজের প্রফেসর নিশ্চিত, মন দিয়ে পড়লে ইয়াসমিন মাস্টার্সেও ফার্স্ট ক্লাস পাবে। বাড়ি এসে ইয়াসমিন সবাইকে জানিয়ে দিল ওর ভাল ফলের খবর। আনন্দ ভাগ করে দিল সবাইকে। সবাই বসে পরীক্ষার ভাল ফলের আনন্দ খেল। কেবল ইয়াসমিনের ভেতরের কষ্টগুলোর দিকে কারও নজর পড়ল না। কষ্টগুলো ওর একার। তারপর তো সেই দিনটি এল, ভয়াবহ সেই দিনটি। যে দিনটিতে আমি ময়মনসিংহে নেই, দুদিন আগে গিয়েছি ঢাকায় বই এর খবর নিতে। ফিরে এসে দেখি ইয়াসমিন বাড়িতে নেই। গতকাল ভোরবেলায় চলে গেছে, কোথায় গেছে কেউ জানে না। একটি চিরকুট আমার টেবিলের ওপর।

বুবু, আমি যাচ্ছি। এ বাড়িতে আর ফিরব না। আমার খোঁজ কোরো না।

মা স্তব্ধ বসে ছিলেন।

‘কই গেছে ইয়াসমিন? কেন গেছে? কি হইছিল?’ চেঁচাই।

মা আমার চেঁচানোর বিপরীতে চেঁচান না। সারা গা আমার হিম হয়ে থাকে। বাবার বোনের মেয়ে ওরফে আমাদের ফুপাতো বোন ওরফে অবকাশের কাজের মেয়ে সুফি জানায় খুব ভোরে একটি কালো শাড়ি পরে ইয়াসমিন বেরিয়ে গেছে। মা অনেকক্ষণ পর মুখ খোলেন, ‘তর বাপে মাইরা ওরে রাখছে কিছু! যাইব না কেন? এই বাড়ি থেইকা যাওয়াই ভাল।’ মা ধীরে ধীরে চোখের জল ঝরাতে ঝরাতে বর্ণনা করেন গত রাতের ভয়াবহ বীভৎসতার — বাবা হয়ে কি করে নিজের বড় হওয়া মেয়েকে পাষণ্ডের মত চাবুক দিয়ে মেরেছেন। মাথা থেকে পা পর্যন্ত একতিল জায়গা নেই যেখানে চাবুক পড়েনি। বাবার হাতে মুঠি মুঠি চুল উঠে এসেছে, এমন জোরে টেনেছেন চুল। এমন জোরে হিড়হিড় করে জামা ধরে টেনেছেন, জামা ছিঁড়ে গেছে। সারা গা লাল হয়ে ফুলে গেছে। কী দোষ ছিল ওর? ও ফিরেছে রাত বারোটায়, বাবা অস্থির পায়ে বারান্দায় হাঁটাহাঁটি করছিলেন ইয়াসমিনের ফেরার অপেক্ষায়। কালো ফটকের কাছে একটি গাড়ি এসে থামলে দৌড়ে তিনি ফটকের কাছে দৌড়ে গিয়ে দেখেন ইয়াসমিন একটি গাড়ি থেকে নামল, যে গাড়িতে বসা ছিল দুটো ছেলে। বাবা যদি জানতে চাইতেন, ছেলে দুটো কে? জানতেন, ওরা প্রবীর আর শাকিল। ইয়াসমিনকে দিদি বলে ডাকে ওরা। দিদির মতই ওদের পরবে অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকে ও, ওদের দুঃখে সুখে সঙ্গী হয়। হাঁটুর বয়সী প্রবীর আর শাকিল কোত্থেকে এক গাড়ি যোগাড় করেছে, আনন্দে নাচতে নাচতে ইয়াসমিনকে আবদার করেছে, দিদি চলেন ‘ঢাকা ঘুইরা আসি।’ কথা, সকালে গিয়ে বিকেলে ফিরবে গাড়ি। প্রবীর জীবনে কখনও ঢাকা যায়নি। নাচতে নাচতে ইয়াসমিনও গেল। বিকেলেই ফিরত গাড়ি, কিন্তু ফেরার পথে গাড়ি গেল নষ্ট হয়ে। তাই মধ্যরাত। তাই চাবুক। তাই যে দিকে দুচোখ যায় চলে যাওয়া। আমি মাঝখানে হিম হয়ে আছি। মাকে নিয়ে যখন বেরোই ওকে খুঁজতে, তখন বিকেল। প্রথমেই নানির বাড়িতে গিয়ে শুনি কাল রাতে নানির বাড়িতে ইয়াসমিন ছিল। খুব বিষণ্ন ছিল ওর মুখ। কাউকে বলেনি কী ঘটেছে বাড়িতে। কিছু যে ঘটেছে নানির বাড়ির কেউই ভাবেনি, ভেবেছে ইয়াসমিন শখ করে বুঝি নানির বাড়িতে একটি রাত কাটাচ্ছে। আজ দুপুরের দিকে পরনের কালো শাড়িটি খুলে রেখে হাশেম মামার মেয়ের একটি জামা পরে বেরিয়ে গেছে। আরও আত্মীয়দের বাড়িতে, বন্ধু বান্ধবীদের বাড়িতে খুঁজে দেখি কোথাও ও নেই। বাড়ি ফিরে আশায় থাকি রাতে হয়ত ফিরে আসবে। না, ও ফেরে না সে রাতে। পরদিনও আবার খোঁজাখুঁজি। টেলিফোনে খবর নেওয়া এ বাড়ি ও বাড়ি। কেবল ময়মনসিংহে নয়, ঢাকায় আত্মীয় বন্ধুদের বাড়িও খবর নেওয়া হয়েছে। নেই। পরদিন আসে। পরদিন যায়। একফোঁটা ঘুম নেই, একদানা খাওয়া নেই, একবিন্দু জলে ছোঁয়ানো নেই শরীর, উৎকণ্ঠার সমুদ্রে মাছের মত ডুবে আছি। ইয়াসমিন ফিরছে না। দিন আরেকটি পার হল। ও ফেরে না। কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সবুর, ইয়াসমিনের ভাল বন্ধু, আসে খোঁজ নিতে। নিজেও বাড়ি বাড়ি যায় খুঁজতে। যে বাবা সবুরের দিকে কড়া চোখে তাকাতেন কখনও সামনে পড়লে, তাকে বাপ ডেকে জানতে চান কোথায় যেতে পারে মেয়ে। কোথাও না পেয়ে সবুর নিজে গিয়ে হাসপাতালে খুঁজে এলো, ওখানেও নেই। তিনদিন পর মিলনের বাড়ি থেকে খবর এল ফুলপুরে ওর ক্লাসের এক বন্ধু জামানের বাড়িতে আছে ও। ও নাকি মিলনকে বিয়ে করেছে। খবরটি রাতে এল। সারারাত আমি ঘরময় অস্থির হাঁটি আর নিজেকে প্রবোধ দিই বলে যে এ নাটক, আবার নতুন কোনও নাটকের আয়োজন করেছে ইয়াসমিন। দুঃসংবাদটি আর যা কিছুই হোক, যেন সত্য না হয়। হাসিনা ফুলপুরের মেয়ে, পথঘাট চেনে, ওকে সঙ্গে নিলে বাড়ি খুঁজতে সুবিধে হবে বলে ওকে নিয়ে ভোরবেলায় ফুলপুরে রওনা হলাম। ব্রহ্মপুত্র নদ পেরিয়ে মুড়ির টিন বাসে করে লোকের গা ধাককা খেতে খেতে ভাঙা রাস্তায় বাসের ওঠানামায় মাথায় বাসের ছাদের দেয়ালের ঠোকর খেতে খেতে লোকের ঘামের গন্ধ বাচ্চাকাচ্চার মলমুত্রবমির গন্ধ শুঁকতে শুঁকতে পৌছলাম ফুলপুর বাস স্টেশন। ফুলপুর বাজারে লোকদের জিজ্ঞেস করে করে জামানের বাড়ি কোথায় কোন পথে তা জেনে পথ হেঁটে অবশেষে একটি টিনের বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াই। হাসিনা ভেতর ঘর থেকে খবর নিয়ে এল, ইয়াসমিন এ বাড়িতে আছে এবং ও বিয়ে করেছে মিলনকে, করেছে গতকাল। না, এ খবরটি আমি বিশ্বাস করতে চাই না। এ মিথ্যে খবর। কেউ আমাকে বলুক, বলুক যে খবরটি সত্যি নয়, আমি আশেপাশে তাকাই সেই কারও জন্য। ঘরের ভেতর ঢুকে দেখি একটি অগোছালো বিছানায় দুটো বালিশ পাশপাশি, একটি বালিশের কাছে ইয়াসমিনের চুলের ক্লিপ। তবে কি এই বিছানাতেই মিলনকে নিয়ে শুয়েছে ও রাতে! বিয়ে কি সত্যি সত্যিই করেছে! আমার তবু বিশ্বাস হতে চায় না। এই মুহূর্তে বাড়ির ছাদ যদি ধ্বসে পড়ত মাথায়, এই মুহূর্তে যদি ব্রহ্মপুত্রের বন্যা ভাসিয়ে নিত এই পুরো ফুলপুর! প্রলাপের মত বকতে থাকি ‘ইয়াসমিন চল, তাড়াতাড়ি চল, আমি আইছি তরে নিতে, বাবার সাথে রাগ কইরা আইসা পড়ছস, ঠিক আছে, এখন চল যাই বাসাত।’ কে শোনে আমার প্রলাপ! দূর থেকে দেখি উঠোনের রোদে একটি অচেনা শাড়ি পরে বসে আছে ইয়াসিমিন, মাথা মুখ আড়াল করে রেখেছে শাড়ির আঁচলে। হু হু করে ওঠে বুক। যেন বুকের ভেতরে যা ছিল এতদিন, কোনও এক হায়েনা এসে সব কামড়ে খেয়ে গেল। আমাকে থামায় হাসিনা আর জামান, বলে ‘বিয়ে যখন হয়েই গেছে..’ বিয়ে আবার কি! ওকে নিয়ে যেতে এসেছি আমি, আমার সঙ্গে যাবে ও। হাসিনা গিয়ে আমি যে যেতে বলছি ইয়াসমিনকে আমার সঙ্গে তা জানালে ইয়াসমিন বলে দিল ও যাবে না। চোখের সামনে আমার হারিয়ে যাওয়া বোন, আর আমাকে বাড়ি ফিরে যেতে হবে খালি হাতে, খালি বুকে! আমার সয় না। ও আমার সামনেও আসবে না, আমাকে মুখও দেখাবে না, আমার সঙ্গে যাবেও না। যতক্ষণ শরীরে মনে একবিন্দু শক্তি অবশিষ্ট ছিল, অনুরোধ করেছি, আদেশ করেছি আমার সঙ্গে যেতে, বিয়ে হয়েছে ঠিক আছে, মিলন তার বাড়িতে ফিরুক, ইয়াসমিন অবকাশে ফিরে আসুক। দুজনে লেখাপড়া করুক, তারপর ঘটা করে লোক জানিয়ে বিয়ে দেওয়া হবে দুজনের। না, মানবে না ও। ঠিক আছে, বাড়ি চল, লেখাপড়া শেষ করতে না চাও, সংসার করার সময় হয়নি যদিও, কোথায় থাকবে কি করবে তা অন্তত আমাদের বুঝতে দাও, চল বাড়ি চল, বিয়ের ব্যবস্থা করা হবে। না মানবে না ও। ঠিক আছে কালই করা হবে। না, কিছুই ও শুনবে না, যাবে না কোথাও ও। মিলন ওর স্বামী, স্বামীর সঙ্গে থাকবে ও। ওর আত্মীয় স্বজন বাবা মা ভাই বোনের চেয়ে বড় ওর স্বামী। আমাকে কেঁদে ফিরে আসতে হয়। আমাকে ভাসতে হয় নিজের ব্রহ্মপুত্রে। ও ফিরিয়ে দিল আমাকে। পুরো জগত তখন টলছে আমার সামনে। স্বপ্ন বলতে আমার যা ছিল, ভেঙে পড়ে আকস্মিক এক তুমুল তুফানে। ইয়াসমিনকে নিয়ে আমি একটি জীবন তৈরি করেছিলাম, কবিতার গানের জীবন, সেই জীবনটি বড় নিঃস্ব হয়ে যায়। হঠাৎ এক ভূমিকম্পে গুঁড়িয়ে যায় আমাদের উচ্ছঅল উতল জীবন। সর্বস্বান্ত হয়ে ময়মনসিংহ শহরের বাসে উঠি। বাসের ভেঁপুতে, কালিতে, বিকট চিৎকারে, দীর্ঘশ্বাসে ধুঁকতে ধুঁকতে বাড়ি ফিরি। বাড়ি খাঁ খাঁ করে। এত একা এ বাড়িতে আমার লাগেনি কখনও। বাড়িতে বাবা আছেন, মা আছেন, দাদা আছেন, কিন্তু কেউ যেন নেই। যেন একটি প্রাণী অবশিষ্ট নেই অবকাশে। নিজের কান্নার শব্দ শুনি একা একা। বাবার পুরুষরোগ, মার ধর্মরোগ, দাদার মুমুরোগ থেকে আমি নিজেকে অনেক আগেই দূরে সরিয়ে নিয়েছিলাম। ঘনিষ্ঠতা ছিল এক ইয়াসমিনের সঙ্গেই। অবকাশে ও ছাড়া আমার আপন কেউ ছিল না। যে মেয়েটি ধীরে ধীরে কবি হয়ে উঠছিল, গায়িকা হয়ে উঠছিল, ধীরে ধীরে ওর বয়সী যে কোনও মেয়ের চেয়ে ও অনেক বেশি সুচারু সুন্দর হয়ে উঠছিল, যে মেয়েটির এমনই অসাধারণ প্রতিভা, সে এমন এক সাধারণ ছেলের সঙ্গে বাকি জীবনের জন্য জীবন জড়ালো, যে ছেলে গানের গ ও জানে না, কবিতার ক ও না! বিষাদ আমাকে আচ্ছ!্বদিত করে রাখে, আশঙ্কা আমার শিয়রের কাছ থেকে নড়ে না। যে মেয়েটি স্বাধীনতা কাকে বলে ধীরে ধীরে শিখে উঠেছে, আর শিখে, পরিণত হয়ে সে এখন নিজেই নিজেকে পরাধীনতার শেকলে জড়িয়েছে সাধ করে। কালো উঠোন শাদা করে জ্যোৎস্না নামে। আমি একা বসে থাকি সে উঠোনে। কেউ নেই পূর্ণিমার একটি গান গায়, কেউ নেই আমাকে বুবু বলে ডাকে আর। মা মিহি সূরে কাঁদেন। বাবা কপালের শিরা চেপে বসে থাকেন। অবকাশের শিরদাঁড়ায় বোবা একটি যন্ত্রণা স্থির হয়ে থাকে।

অনেক অনেক বছর পর ইয়াসমিন যখন স্বামী সন্তান নিয়ে সংসার করছে, বলেছে সেদিন ভোরবেলা আলমারি থেকে আমার একটি কালো শাড়ি পরে বেরিয়েছিল মনের দুঃখে। বাবার ওই নিষ্ঠুর চাবুক ওর নিজের ওপর ধিককার এত বেশি বাড়িয়ে তুলেছিল যে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল। কলেজে গেছে, ক্লাস করেছে, ক্লাস শেষে প্রবীরদের বাড়িতে গিয়ে অনেকক্ষণ বসে থেকে অবকাশে ফিরে গিয়েছিল, কালো ফটকের সামনে দাঁড়িয়ে থেকেছে কিছুক্ষণ। ভেবেছে ঢুকে যাবে, কিন্তু আবারও অভিমান এসে ওকে আবৃত করেছে। রিক্সা নিয়ে তখন সোজা নানির বাড়িতে গেছে, রাতে ঘুমিয়েছে, অপেক্ষা করেছে অবকাশ থেকে কারও আসার, কেউ এসে ওকে নিয়ে যাবে বাড়িতে। কেউ আসেনি। ওর ইচ্ছে করেছিল ঢাকা যেতে, কিন্তু হাতে ঢাকা যাওয়ার টাকা ছিল না, কারও কাছ থেকে টাকা ধার চাইতেও ওর লজ্জা হয়েছে। রাত কাটিয়ে পরে কলেজে গেছে, ওখানে থেকে আবার গেছে অবকাশে। আবারও দাঁড়িয়ে থেকেছে কালো ফটকের কাছে। ঢুকবে। শেষ অবদি ঢোকেনি। কোথায় যাওয়া যায়! ভাবতে ভাবতে শেষে কলেজস্ট্রিটে জামান নামে ক্লাসের একটি ছেলে থাকে, গ্রামের ছেলে শহরের কলেজে পড়ে, ছোট একটি ঘর ভাড়া নিয়ে থাকে, তার ঘরে গিয়ে অনেকক্ষণ বসে থাকে। কি হয়েছে কী ঘটেছে কিছু কাউকে বলে না। কি করবে বুঝে পায় না। কোথায় যাবে বুঝে পায় না। বাড়িতে না ফিরতে হলে একটি জিনিসই করতে হবে ওর, বাবার নিষ্ঠুরতার প্রতিশোধ একটি কাজ করেই ও নিতে পারে সে হল বিয়ে। আত্মহত্যার কথা ভেবেছে, কিন্তু ভয় লাগে আত্মহত্যা করতে। তাছাড়া বিষ যোগাড় করাও ঝামেলা। সুতরাং ওই একটি উপায়ই আছে, মেয়ে মানুষ যখন, মেয়ে মানুষের বাবার বাড়ি ছাড়া আরও একটি যাওয়ার জায়গা থাকে, সে হল স্বামীর বাড়ি। কিন্তু কাকে বিয়ে করবে ও! কাকে প্রস্তাব দেবে বিয়ের! কাকে লজ্জার মাথা খেয়ে বলবে, আমাকে বিয়ে কর! যার কথাই মনে আসে ওর, ভয় হয় হয়ত ফিরিয়ে দেবে। হয়ত ওকে কেউ বিয়ে করতে চাইবে না। তখনই অনেকদিনের ভুলে যাওয়া মিলনের কথা ভাবে ও। মিলনকে খুঁজতে বের হয় ইয়াসমিন। পায় রাত্তিরে। কোনও রাখ ঢাক না করেই বলল, আমি বিয়ে করব এবং আজই। বিয়ে করতে চাইলে এক্ষুনি কর। তা না হলে আর আমাকে পাবে না। মিলন হতভম্ব। মিলন বলে, বাড়ি থেকে নাকি তোমার বিয়ের ব্যবস্থা করেছে! ইয়াসমিন পুরোনো কথায় ফিরতে চায়নি। সে রাতেই ওরা চলে গেছে শহর ছেড়ে জামানকে নিয়ে। জামান ফুলপুরে নিজের বাড়িতে দুজনের থাকার ব্যবস্থা করেছে। পরদিন ফুলপুরে বিয়ের মত ব্যপারটি ঘটাতে ভয় ছিল ইয়াসমিনের, যদি কেউ ওকে চিনে ফেলে যে ও ডাক্তার রজব আলীর মেয়ে! যদি খবর রটে যায়! জামান ওদের নিয়ে হালুয়াঘাটে গিয়েছে, ওখানে রেজিস্ট্রি আপিসে নিয়ে দুজনকে দিয়ে বিয়ের কাগজে সই করিয়ে নিয়ে এসেছে। এটিও সহজ ছিল না। মেয়ে ভাগিয়ে নিয়ে এসেছে বলে মিলন আর জামানকে সন্দেহ করা হয়। সন্দেহ মোচন করার জন্য দারোগাকে ঘুস দিয়ে কাজ সারতে হয়েছে।

আমি বাড়ি ফিরে মাকে বার বার বলেছি, কেঁদে ভেসে বলেছি, ‘কেন তুমি সেই রাতে নানির বাসায় খুঁজতে গেলা না ওরে!’ মা নিজের অপরাধের জ্বালায় ছটফট করেছেন, পাগলের মত কেঁদে কেঁদে বলেছেন, ‘আমি যদি জানতাম! আমি তো জানি না যে ওর নানির বাসায় ও আছে।’

‘তুমি গিয়া যদি নিয়া আইতা, তাইলে তো হইত না এইসব কাণ্ড!’

অঝোর ধারায় ঝরে মার চোখের জল। ‘আমি যদি জানতাম.. ভাবছি ফিইরা আইব। রাগ কইমা গেলে ফিইরা আইব। আমার কোলটা খালি হইয়া গেল..’

ইয়াসমিনের জীবন সম্পূর্ণই পাল্টো গেছে, আর ও আগের ইয়াসমিন নেই, আর ও আগের মত এই অবকাশ জুড়ে হাঁটবে না, গান গাইবে না, গাইবে না ওর প্রিয় গানটি আর, আমরা এমনি এসে ভেসে যাই, আর ও আগের মত আবৃত্তি করবে না, আর ও এ বাড়ি থেকে কলেজে যাবে না, কলেজ থেকে এ বাড়িতে ফিরবে না, আর বিকেল হলেই আমার সঙ্গে রিক্সায় চড়ে শহর ঘুরে বেড়াবে না, ওর অফুরন্ত সম্ভাবনার আর স্বাধীনতার জীবনে ইতি টেনেছে ও। ইয়াসমিন অবকাশ ছেড়ে চলে গেছে, বিয়ে করেছে একই ক্লাসে পড়ছে এক ছেলেকে, যে ছেলে কোনও একটি বাক্য শুদ্ধ করে বলতে জানে না, এ খবরটি আর ইয়াসমিন মরে গেছে খবরের মধ্যে আমার মনে হয় না কোনও ফারাক আছে। যে আমার ছায়ার মত আমার পাশে থাকত, সে নেই, সে মরে গেছে। সবচেয়ে আপন কেউ সবচেয়ে কাছের কেউ সত্যিকার মরে গেলে যেমন কষ্ট হয় আমার ঠিক তেমন কষ্ট হতে থাকে। আচমকা আমার সব তছনছ হয়ে যায়। এত একা আমার জীবনে কখনও আমি বোধ করিনি। পুরো জগতটি আমার এত খালি খালি কোনওদিন লাগেনি। নিজের জন্য যত কষ্ট হয় তার চেয়ে সহস্রগুণ হয় ইয়াসমিনের জন্য। অবকাশ খাঁ খাঁ করে। পুরো শহর খাঁ খাঁ করে। আমি ছুটি নিয়ে চলে যাই ঢাকায়। মা দুঃখ বেদনা যা আছে ভেতরে নিয়ে ইয়াসমিনকে দেখতে যান মিলনদের বাড়িতে যখন ও ফিরে আসে। ইয়াসমিনের অমন হারিয়ে যাওয়ার খবর পেয়ে সৈয়দ শামসুল হক ময়মনসিংহে ছুটে আসেন। সার্কিট হাউজে একদিন থাকেন, ওখান থেকে ফোনে কথা বলেন ইয়াসমিনের সঙ্গে। ওকে ফিরতে বলেন আগের জীবনে, রাগ করে এত বড় সর্বনাশ যেন না ঘটায়। ও ফেরে না। আমারও আশা ছিল ফিরবে, এরকম তো হয় মানুষের জীবনে, রাগ করে বিয়ের মত কাণ্ড ঘটিয়ে দেখে যে ভুল করেছে, তখন ফেরে। কত কেউ ফেরে, ইয়াসমিন ফেরে না।

কলকাতা থেকে ফিরে অবকাশে একা বসে থাকি। কেউ নেই যার কাছে কোথায় গিয়েছি কি করেছি সব গল্প শোনাবার। কেউ নেই যাকে নিয়ে বসে কলকাতা থেকে আনা গানের আর আবৃত্তির ক্যাসেট গুলো শুনব। আমার সুটকেস পড়ে থাকে সুটকেসের মত, কেউ ঝাঁপিয়ে খোলে না, কেউ বলে না কি কি আনছ দেখি, আর পছন্দ হলে এইটা আমারে দেও ওইটা আমারে দেও আবদার করার। শান্তিদেব ঘোষের খালি গলায় আমি কান পেতে রই গানটি শুনতে শুনতে উদাস শুয়ে থাকি অবকাশের একলা বিছানায়। ইয়াসমিন যদি অবকাশে থাকত, সেই আগের মত থাকত, গানটি শুনে ও পাগল হয়ে যেত। সেই মন খারাপ করা বিকেলে ফোন করি মিলনের বাড়িতে, ফোনের ওপাশে ইয়াসমিনের গলা শুনে রিসিভারটি পেতে রাখি আমি কান পেতে রই গানটির কাছে। গানটি শেষ হলে নিঃশব্দে কান পেতে থাকি ওদিক থেকে নিঃশ্বাসের শব্দ ভেসে আসে কি না, ওদিকেও কান পেতে আছে কি না ও। আছে, কান পেতে আছে, ওদিক থেকে কান্নার শব্দ ভেসে আসছে। এদিকে বুক ভেঙে যাওয়ার শব্দ। একটি হু হু করা সুর বুঝি সত্যিকার গানের শিল্পীকে না কাঁদিয়ে পারে!

বিয়ে যখন করেছেই, যখন ফেরানোই যাবে না, অবকাশের সবাই ইয়াসমিনের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করল। এক আমি ছাড়া। ইয়াসমিনও হঠাৎ হঠাৎ অবকাশে আসে পাজামা পাঞ্জাবি পরা মিলনকে নিয়ে। অতিথির মত আধঘন্টা একঘন্টা থেকে চা বিস্কুট খেয়ে ফিরে যায় শ্বশুর বাড়িতে। ও এলে আমি ঘরের দরজা বন্ধ করে বসে থাকি। বাবা যেদিন দীর্ঘ দীর্ঘ শ্বাস ফেলে মার ক্রমাগত অনুনয়ের পর মেনে নিলেন বিয়েটি এবং ইয়াসমিনকে লাল বেনারসি আর সোনার গয়না গাটি কিনে দিয়ে মিলনের কিছু আত্মীয় স্বজনকে খাইয়ে বিয়ের ঘরোয়া অনুষ্ঠানটি করে দিলেন অবকাশ থেকে, সেদিনও আমার ঘরের দরজা বন্ধ ছিল। এই ইয়াসমিন অন্য ইয়াসমিন, আমি পারিনি ওর সামনে সহজ হতে, ও নিজেও পারেনি। ও এখন যে কোনও গৃহবধু, ও এখন বিয়ে হয়ে যাওয়া যে কোনও মেয়ে। খবর পাই শ্বশুর বাড়ির কড়া নিয়ম কানুনের মধ্যে আছে ও। শাশুড়ি, ভাসুর, ভাসুর বউ, স্বামী, স্বামীর আরও আত্মীয় স্বজনের মধ্যে ও নিজেকে মিশিয়ে ফেলেছে। ওদের সুখ দুঃখই এখন ওর সুখ দুঃখ। ওরাই এখন সবচেয়ে ওর কাছের মানুষ। বাইশ বছর যার সঙ্গে কাটালো তার চেয়ে বেশি আপন এখন বাইশ দিনের পরিচিত মানুষ। ও এখন বিয়ে হয়ে যাওয়া যে কোনও মেয়ে। শ্বশুর বাড়ির মুরব্বিদের দেখলে মাথায় আঁচল তুলে দেওয়া মেয়ে। তাদের আদেশ নির্দেশ নতমস্তকে পালন করা মেয়ে। ও এখন শ্বশুরবাড়ির বয়সে বড়দের পায়ে পায়ে কদমবুসি করা মেয়ে। ও এখন রান্নাঘরে বসে শাশুড়ির কাছ থেকে কি করে রান্না করতে হয় শিখছে, কি করে স্বামীর পাতে মাছ মাংস দিতে হয় শিখছে, কি করে ঘরে বসে স্বামীর জন্য অপেক্ষা করতে হয় শিখছে, কি করে মাথায় ঘোমটা টেনে ভাসুরের সামনে নত মুখে দাঁড়াতে হয় শিখছে, কি করে শ্বশুর বাড়ির সবার সঙ্গে নরম সূরে, নরম স্বরে কথা বলতে হয় শিখছে। কি করে ঘর গুছোতে হয়, কি করে কিছু আসবাবপত্র আর হাঁড়িপাতিলের স্বপ্ন দেখতে হয় শিখছে। কি করে নিজের স্বপ্নগুলো ভুলে যেতে হয় শিখছে। কি করে গান ভুলতে হয় শিখছে, কবিতা ভুলে যেতে হয় শিখছে। কি করে নিজের জীবনের সব সুরগুলো ভুলে যেতে হয় শিখছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *