ফয়জুল লতিফ চৌধুরী
‘প্লট সম্বন্ধে আমাকে কোনো দিন চিন্তা করিতে হয় নাই। কতকগুলি চরিত্র ঠিক করিয়া লই। তাহাদিগকে ফুটাইবার জন্য যাহা দরকার, আপনি আসিয়া পড়ে।’-শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
‘সবই সদ্য, বুঝিয়াছ? আগামীকাল না আসিবা পর্যন্ত গতকালের যবনিকাপাত হইবে না। আর আগামীকালের সূচনা হইয়াছে তো দশ হাজার বৎসর আগে।’-উইলিয়াম ফকনার
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় আধুনিক বাংলা কথাসাহিত্যের অন্যতম স্থপতি। বাংলা কবিতায় জীবনানন্দ দাশ যে যুগস্রষ্টার অবদান রাখিয়াছেন, মাত্র ৪৮ বৎসরের জীবৎকালে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় কথাসাহিত্যে সমতুল্য কীর্তি রাখিয়া গিয়াছেন। ব্যাধি ও দারিদ্র্য যুক্তি করিয়া তাঁহাকে আমৃত্য ঠ্যাঙ্গাইয়াছে। তদসত্ত্বেও তিনি চল্লিশটি উপন্যাস এবং দুই শত গল্পের বিশাল বিচিত্র ভাণ্ডার রাখিয়া গিয়াছেন। ১৯৩৫-এ প্রকাশিত তাঁহার প্রথম উপন্যাস দিবারাত্রির কাব্য এবং পরবর্তী বৎসর প্রকাশিত দুইটি উপন্যাস পদ্মানদীর মাঝি ও পুতুল নাচের ইতিকথা বাদ দিয়া বাংলা কথাসাহিত্যের ইতিহাস রচিত হইতে পারে না।
তাঁহার আলোচনা সূত্রে সাধারণত যে প্রসঙ্গটি প্রায়োবধারিতভাবে উত্থাপিত হইয়া থাকে তাহা হইল তাঁহার বিশিষ্ট গদ্যরীতি। এই কথা অনস্বীকার্য যে তিনিই সর্বাগ্রে মুখের ভাষাকে সাহিত্যে অভ্যর্থনা জানাইয়াছেন। সেই হইতে কথ্যরীতির ভাষা বাংলা সাহিত্যে স্থায়ী আসন লাভ করিয়াছে। কিন্তু ভাষাকেন্দ্রিক আলোচনার অবকাশে যে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি আড়াল থাকিয়া যায়, তাহা হইল মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁহার গল্প-উপন্যাসে এমন সব বিষয় ও অনুষঙ্গ, ঘটনা ও দুর্ঘটনা সন্নিবেশিত করিয়াছেন, যাহা অভূতপূর্ব।
বস্তুত, সাহিত্যের ভূমিতে গোড়াপত্তন করিতে হইলে লেখককে ‘অকথিত বাণী’র পসরা লইয়া উপস্থিত হইতে হইবে। জগৎ-সংসারের কত না কিছু ঘটিতেছে, যাহা সচরাচর সাধারণ মানুষের দৃষ্টির অন্তরালে, অনুধাবনের ঊর্ধ্বে থাকিয়া যায়। লেখক তাহা আবিষ্কার করিবেন, অতঃপর কল্পনার ময়ান দিয়া তাহাকে রসসমৃদ্ধ করিয়া পরিবেশন করিবেন যাহাতে পাঠকের চিত্ত আন্দোলিত হয়, তাহার মননে আলোড়ন ওঠে। ইহা কথাসাহিত্যিকের প্রধান দায়। এই দায় পরিশোধ হয় এমন চরিত্র সৃষ্টির মধ্য দিয়া যাহা অদৃষ্টপূর্ব, অনুকরণীয়। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কুবের, হোসেন মিয়া, কুসুম, শশী ডাক্তার, ভিখু, সরসী, মঙ্গলা এমনই সব অবি্নরণীয় চরিত্র।
কি অতীত কি বর্তমান-সর্বত্র সাহিত্যের উপাচার বিরাজমান। তাহা সংগ্রহ করিয়া বিভিন্ন লেখকের বহুবর্ণ রচনার মধ্য দিয়া ক্রমান্বয়ে সাহিত্য তুলিতেছেন। এই সৃষ্টি প্রক্রিয়া অবিশ্রান্ত। এই অর্থে সাহিত্য সদা জায়মান যাহা নতুন লেখকের নব অবদানে সমৃদ্ধ হইবার অপেক্ষায় নিয়ত অপেক্ষমাণ। তৎকালীন প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে পদ্মানদীর মাঝি লিখিত হইয়াছিল ১৯৩৫-এ। ২০০৮-এর নতুন পাঠকের জন্য তাহা অভিনব প্রতীয়মান হইবে। হুমায়ূন আহমেদ মধ্যাহ্ন লিখিতেছেন এক শত বৎসর আগের ঘটনা উপজীব্য করিয়া। সমসাময়িক পাঠকের কাছে তাঁহার আবেদন দুর্নিবার প্রমাণিত হইয়াছে।
২·
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রাগৈতিহাসিক প্রকাশিত হয় ১৯৩৭-এ। ইহা তাঁহার লেখক-জীবনের প্রথম গল্পসমূহের একটি। বসন্তপুরে বৈকুণ্ঠ সাহার বাড়িতে ডাকাতি করিতে গিয়া দলের দশজন ধরা পড়িল, ভিখু পালাইতে সক্ষম হইল। কাঁধে বর্শার মারাত্মক ক্ষত লইয়া একদিন একরাত্রির পথ হাঁটিয়া চিতলপুরে পৌঁছিল ভিখু; কিন্তু পেহ্লাদ বাগদি তাহাকে স্বগৃহে আশ্রয় দিবার ঝুঁকি নিতে রাজি হইল না; তবে অদূরবর্তী জঙ্গলে মাচা বাঁধিয়া লুকাইয়া থাকিবার একটা ব্যবস্থা হইল।
বর্ষার জঙ্গলে এক-আধবেলা থাকা চলিতে পারে-তাহার বেশি নহে। প্রাণ বাঁচাইতে বন্য জন্তুরাও অন্যত্র সরিয়া পড়ে; কিন্তু ভিখু মানুষ, এত সহজে মৃত্যুকে সে বরণ করিবে না। কয়েকদিনে অযত্নে অচিকিৎসায় অনাহারে ভিখুর অবস্থা সঙ্গীণ হইয়া উঠিল। উপায়ান্তর না দেখিয়া পেহ্লাদ ভিখুকে স্বগৃহে লইয়া আসিয়া খড়ের উঁচু গাদার উপর থাকিবার ব্যবস্থা করিয়া দিল। ভিখু প্রাণে বাঁচিয়া গেল, তবে তাহার ডান হাতটি চিরতরে অকেজো হইয়া গেল।
এমনি একদিন নির্জন পাইয়া খড়ের গাদা হইতে নামিয়া ভিখু পেহ্লাদের স্ত্রীর ওপর চড়াও হইল। বাগদির মেয়ে এত সহজে ধরা দিবার পাত্রী নহে। বাড়ি ফিরিয়া পেহ্লাদ সব শুনিল। বেদম পিটুনির পর ভিখু বহিষ্কৃত হইল কিন্তু ওই রাত্রেই পেহ্লাদের ঘরে আগুন দিয়া ঘাটে বাঁধা নৌকা চুরি করিয়া সে পালাইল। তাহার পরবর্তী ঠিকানা হইল নিকটবর্তী মহকুমা সদরের বাজার।
ক্ষুধার জ্বালায় সে ভিক্ষা করিতে শুরু করিল। বাজারের তেঁতুলগাছের তলায় অচিরেই সে ভিক্ষাবৃত্তিতে স্থায়ী হইল। পথচারীদের মন গলাইবার কলাকৌশলও সে আয়ত্ত করিয়া ফেলিল। উপার্জন আশানুরূপ হইলে বর্ষার শেষে সে বস্তির ঘরে থাকিবার একটি ব্যবস্থাও সে করিয়া ফেলিল।
গ্রাসাচ্ছাদনের সুস্থির ব্যবস্থা হইবার সঙ্গে সঙ্গে তাহার স্বাস্থ্য ফিরিল। কিন্তু নারীসঙ্গ বিবর্জিত বিশুষ্ক জীবন তাহাকে অস্থির করিয়া তুলিল। শেষ পর্যন্ত সে পাঁচীকে প্রস্তাব দিয়া বসিল। পাঁচী হাটের বাহিরে বসিয়া ভিক্ষা করে। তাহার পায়ে দগদগে ঘা, তবে ইতোমধ্যে সে এক ল্যাংড়া ভিখারি বসিরের সহিত প্রণয়াবদ্ধ হইয়াছে।
একদিকে পাঁচীর সঙ্গে কোনো রফা হইল না, অন্যদিকে অদৃষ্টক্রমে ভিখুর আয়পত্র হ্রাস পাইতে লাগিল। ভাগ্যের উপর্যুপরি নিষ্ঠুর উপেক্ষা তাহাকে পাগলপ্রায় করিয়া ফেলিল। মাঝে মাঝে ইচ্ছা করে সে বস্তির মালিক বিন্নু মাঝির সুখী সংসারের ঘরে আগুন লাগাইয়া নিয়তির উপর প্রতিশোধ নেয়। কিন্তু পাঁচীর কথা সে ভুলিতে পারে না। শেষপর্যন্ত একদিন মনস্থির করিয়া ভিখু তাহার সকল সম্বল পুঁটুলিতে বাঁধিয়া ঘর ছাড়িল, সঙ্গে পাথরে শানানো সড়কি। শঙ্কা থাকিলেও শেষ পর্যন্ত কেবল বাম হাতের কোপে ঘুমন্ত বসিরকে সহজেই খুন করিয়া ফেলিতে সক্ষম হইল ভিখু। বসিরের সমস্ত সঞ্চয় হাতাইয়া ভিখু নতুন ঠিকানার উদ্দেশে পা বাড়াইল। পাঁচী নীরবে সহযাত্রী হইল। পায়ের ঘায়ের কারণে পাঁচী জোর কদমে চলিতে পারে না। অতঃপর
“ভিখু সহসা একসময় দাঁড়াইয়া পড়িল।
বলিল, ‘পায়ে নি তুই ব্যথা পাস পাঁচী?’
‘হ’, ব্যথা জানায় পাঁচী।
‘পিঠে চাপামু?’
‘পারবি, ক্যান?’
‘পারুম, আয়।’
ভিখুর গলা জড়াইয়া ধরিয়া পাঁচী তাহার পিঠের উপর ঝুলিয়া রহিল। তাহার দেহের ভারে সামনে ঝুঁকিয়া ভিখু জোরে জোরে পথ চলিতে লাগিল···।”
৩·
পদ্মানদীর মাঝি বা পুতুলনাচের ইতিকথা সংক্ষিপ্ত পরিসরে বয়ান করা সম্ভব হইবে না বলিয়াই আলোচনার প্রয়োজনে উপন্যাসের স্থলে একটি ছোটগল্প বাছিয়া লওয়া হইয়াছে। তাহাতে মূল প্রতিপাদ্য বিষয়ের ইতর-বিশেষ হইবে না। অধিকাংশ পাঠক ও সমালোচক ‘প্রাগৈতিহাসিক’কে ‘সমাজ-বাস্তবতার’ গল্প হিসাবে পাঠ করিয়া থাকেন। ‘সমাজ-বাস্তবতা কী জিনিস তাহার সংজ্ঞার্থ কেহ নিরূপণ করিয়া দেন নাই। সমস্যা হইল ‘সমাজ-বাস্তব’ বলিয়া কিছু থাকিলে ‘সমাজ-অবাস্তব’ গোত্রের অস্তিত্বও স্বীকার করিতে হয়। সমাজের নিচু জাতের খাটিয়া খাওয়া মানুষের গল্পকেই প্রকৃত বাস্তবতা জ্ঞান করিতে যাহারা অভ্যস্ত ‘সমাজ-বাস্তবতা’ অভিধাটি তাহাদেরই অর্বাচীন উদ্ভাবন বলিয়া প্রতীয়মান হয়।
ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে বাংলা কথাসাহিত্য মূলত গড়িয়া উঠিয়াছিল মধ্যবিত্ত মানুষের জীবনালেখ্য উপজীব্য করিয়া। ইহার পত্তন হইয়াছিল অকৃষিজীবী, মধ্যস্বত্বভোগী, কিঞ্চিৎ শিক্ষিত মানুষের জীবনকাহিনী লইয়া-জমিদার বাবুরা যাহাদের অন্যতম। ১৮৩২ খ্রিষ্টাব্দে প্রকশিত ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের নববিবিবিলাস এই গোত্রেরই একটি উল্লেখযোগ্য রচনা।
বিংশ শতাব্দীর কথাসাহিত্যিকেরা এই ধারাটির গতিমুখ পরিবর্তনের তাগিদ অনুভব করিয়াছিলেন। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় স্পষ্ট ঘোষণা করিলেন যে জমিদারদের কাহিনী বয়ানের দিন শেষ হইয়াছে। উপরন্তু বুদ্ধদেব বসু লক্ষ করিলেন যে বাংলা উপন্যাসের নায়ক-নায়িকারা দারিদ্র্য-দুঃখ ভোগ করে না, সাংসারিক ঝঞ্জাট, পারিবারিক অশান্তির সহিত তাহাদের পরিচয় ঘটে না। গোকুলচন্দ্র নাগের পথিক-এর আলোচনা প্রসঙ্গে একজন সমালোচক উল্লেখ করিলেন যে উপন্যাসের সব পাত্রপাত্রীরই রাশি-রাশি টাকা, কিন্তু তাহা কোথা হইতে আসিতেছে তাহার হদিশ কেহ জানে না। অতঃপর মানুষের দুঃখ, দারিদ্র্য, অসুখ ও ব্যাধির গল্প লিখিত হইতে লাগিল। শরৎচন্দ্র একাই একশ হইয়া পারিবারিক ও সামাজিক দ্বন্দ্ব ও অ-সুখের গল্প রচনা করিয়া তুলনারহিত জনপ্রিয়তা অর্জন করিতে সক্ষম হইলেন।
সাহিত্যে নতুন দিগন্ত উ্নোচন যে লেখকের বড় দায় তাহা উপরে সব্যাখ্যা স্বীকার করা হইয়াছে। তাই বলিয়া অভিজাত্যের বাস্তবতাকে বাতিল করিয়া দেওয়ার প্রস্তাব নিরর্থক। দারিদ্র্য কি জীবন-সংগ্রাম যেমন বাস্তব, আভিজাত্য কিংবা বিলাসিতাও তেমনি। কাজের প্রশ্ন হইল লেখক কী ভঙ্গিতে বাস্তবতাকে পাঠকের জন্য সাহিত্য পদবাচ্য করিয়া তোলেন। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় নি্নশ্রেণীর খাটিয়া খাওয়া মানুষের জীবনকে তাঁহার রচনার উপজীব্য করিয়াছিলেন অন্তর্দৃষ্টির তাগিদে। এক চিঠিতে তিনি লিখিয়াছেন, “মধ্যবিত্ত আর চাষাভুষো ওই মুখগুলো মৃণ্ময় অনুভূতি হয়ে চেঁচাতো ‘ভাষা দাও’, ‘ভাষা দাও’।” এই দাবির উত্তর তিনি আমৃত্যু দিয়াছেন। শরৎচন্দ্রের দৃষ্টি যখন অন্তঃপুরের চৌহদ্দিতে শৃঙ্খলিত হইয়া পড়িয়াছে, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় তখন সাধারণ মানুষের বিচিত্র জীবনের অন্ধি-সন্ধিতে হানা দিতে শুরু করিয়াছেন।
৪·
সন্দেহ নাই গল্প হিসেবে প্রাগৈতিহাসিক যেকোনো মানদণ্ডে উৎকৃষ্ট গণ্য হইবে। কি আখ্যান, কি গাঁথুনি, কি ভাষাশৈলী-সব দিক দিয়াই ইহা আদর্শস্থানীয় একটি ছোটগল্প। লেখকের পর্যবেক্ষণ নিবিড় ও সংবেদী, অথচ গল্পের কোথাও স্বীয় মনোপীঠের ছায়াপাত নাই। তবে কেন এই গল্পের নাম প্রাগৈতিহাসিক ধার্য হইল তাহার একটি দার্শনিক ব্যাখ্যা গল্পের শেষাংশে জুড়িয়া দেওয়া হইয়াছে। বসিরকে খুন করিয়া পাঁচীকে পিঠে বহিয়া জোর কদমে ভিখু পথ চলিতেছে। অতঃপর লেখকের পর্যবেক্ষণঃ
‘পথের দু’দিকে ধানের ক্ষেত আবছা আলোয় নিঃসাড়ে পড়িয়া আছে। দূর গ্রামের গাছ-পালার পিছন হইতে নবমীর চাঁদ আকাশে উঠিয়া আসিয়াছে। ঈশ্বরের পৃথিবীতে শান্ত স্তব্ধতা। হয়তো ওই চাঁদ আর এই পৃথিবীর ইতিহাস আছে। কিন্তু যে ধারাবাহিক অন্ধকার মাতৃগর্ভ হইতে সংগ্রহ করিয়া দেহের অভ্যন্তরে লুকাইয়া ভিখু ও পাঁচী পৃথিবীতে আসিয়াছিল এবং যে অন্ধকার তাহারা সন্তানের মাংস আবেষ্টনীর মধ্যে গোপন রাখিয়া যাইবে তাহা প্রাগৈতিহাসিক, পৃথিবীর আলো আজ পর্যস্ত তাহার নাগাল পায় নাই, কোনো দিন পাইবেও না।’
মানুষের জ্নগত প্রবৃত্তির প্রজ্নান্তরিক ধারাবাহিকতা একটি বৈজ্ঞানিক সত্য। গল্পের শেষে এইরূপ মন্তব্য যে অনাবশ্যক ছিল তাহা উল্লেখ না করিলেও চলে। লেখকের দায়িত্ব গল্প বয়ান পর্যন্ত সীমাবদ্ধ থাকিলেই যথেষ্ট হইত কেননা পাঠক মাত্রই নিজ রুচি, বোধ ও উপলব্ধি অনুযায়ী গল্পের অর্থ করিয়া থাকেন। প্রতিটি পাঠে একটি গল্প নতুন করিয়া রচিত হয়। সাহিত্যিক কী লিখিলেন তাহার চাইতে বড় কথা হইল পাঠকের কাছে কী বাণী পৌঁছাইল। পাঠকালে প্রত্যেক পাঠকই এক-একজন লেখক হইয়া নিজের পছন্দমাফিক কাহিনীর মর্মার্থ করিয়া থাকেন।
লেখক স্বয়ং ভিখু ও পাঁচীর গল্পকে অন্ধকারের গল্প হিসাবে জ্ঞান করিয়াছেন। এই ব্যাখ্যা যথাযথ কি না তাহা লইয়া ন্যায্য তর্ক চলিতে পারে। একজন অনুবাদক ভিখুর যৌনপ্রবৃত্তিকে বড় করিয়া দেখিয়া অনূদিত গল্পের শিরোনাম করিয়াছেন ‘আদিম প্রবৃত্তি’। একজন সমালোচক যৌনতার শ্রেণীচরিত্রকেই এই গল্পের অন্তর্নিহিত বক্তব্য বলিয়া ধারণা করিয়াছেন।
কথাসাহিত্যের বড় একটি অংশে আমরা প্রত্যক্ষ করি নায়কের নোঙর ছিঁড়িয়া জীবনের নৌকাটি টালমাটাল হইয়া পড়িয়াছে। ইহা জমিদারের জন্য যেমন সত্য, ডোম-চাঁড়ালের ক্ষেত্রেও সমধিক সত্য। নায়ক একদিকে, পৃথিবী আরেক দিকে। এই দ্বন্দ্বের মধ্য দিয়া গল্প জমিয়া ওঠে। কখনো এই দ্বন্দ্বের সমাধান হয়, কখনো থাকে অমীমাংসিত। প্রাগৈতিহাসিক গল্পের ভিখু এমনই একটি চরিত্র। জীবনানন্দের নায়ক যখন স্বীয় অসহায়ত্বের নিকট আত্মসমর্পণ করিয়া দিনাতিপাত করে, তখন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভিখু শত অসামর্থ ও বাধা উপেক্ষা করিয়া বাঁচিবার, বিশেষ করিয়া স্বীয় অভিপ্রায় অনুযায়ী বাঁচিবার চেষ্টা করিতে থাকে। ভিখুর এই চারিত্র্য বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। এই গল্পে ভিখু সেই মানুষের প্রতিভূ যে পরাস্ত হইতে জানে না।
মার্ক্সীয় দর্শনে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় দীক্ষিত হইয়াছিলেন আরও পরে। কিন্তু ভিখুর চরিত্রে আমরা প্রত্যক্ষ করি একটি মার্ক্সীয় রাজনৈতিক অভিজ্ঞান, যাহা হয়তো লেখকের উদ্দীষ্ট ছিল না। সর্বরূপ সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও ভিখুর যে দ্রোহ, তাহা অগ্রহণযোগ্য সমাজের বিরুদ্ধে বিপ্লবেরই নামান্তর। প্রাগৈতিহাসিক রাজনৈতিক গল্প নহে। তথাপি ইহার রাজনৈতিক তাৎপর্য দৃষ্টি এড়ায় না।
সূত্রঃ দৈনিক প্রথম আলো।
Leave a Reply