প্রথম খণ্ড
দ্বিতীয় খণ্ড
তৃতীয় খণ্ড

১৩. লোকায়ত ও বৈদিক ঐতিহ্য

দুই : লোকায়তিক চেতনার সঙ্গে বৈদিক ঐতিহ্যের সম্পর্ক। সিদ্ধিদাতাকে অনুসরণ করতে করতেই এ-বিষয়ে যে-তথ্য পাওয়া যায় তা সত্যিই পরমাশ্চর্য। কথাটা একটু খুলেই বলি।

বৈদিক ঐতিহ্য অতি প্রাচীন। উত্তর যুগে যাঁরা এ-ঐতিহ্যের বাহক বলে নিজেদের পরিচয় দিলেন তাঁরা লোকায়তিক চিন্তাধারা সম্বন্ধে ঘৃণায়-বিদ্বেষে মুখর। এবং লোকায়তিকদের পক্ষ থেকেও বৈদিক যাগযজ্ঞের বিরুদ্ধে যে বিদ্রুপ তাও কম তীক্ষ্ণ নয়। উত্তরকালের এই পরিস্থিতি দেখে মনে হয় লোকায়তের সঙ্গে বৈদিক ঐতিহ্যের কোনো সম্পর্কই নেই। কিংবা যা একই কথা, সম্পর্ক্টা নেহাতই অহিনকুলের মতো।

কিন্তু সিদ্ধিদাতার পদচিহ্ন অনুসরণ করে এগোতে এগোতে দেখা গেলো, উত্তরকালের এই পরিস্থিতিটি সনাতন নয়,–নিছক উত্তরকালেরই ব্যাপার। তার মানে, সুদূর অতীতে লোকায়তিক চিন্তাধারার সঙ্গে বৈদিক ঐতিহ্যের বিরোধ ছিলো কিনা তা একান্তই সন্দেহের কথা। কেননা, বৈদিক সাহিত্যের মধ্যেই লোকায়তিক ধ্যানধারণার রাশিরাশি চিহ্ন থেকে গিয়েছে। তার মানে, বৈদিক চিন্তাধারারও একটা ইতিহাস আছে। এবং সে-ইতিহাস দেখলে বোঝা যায় উত্তর যুগে এ-ঐতিহ্যের বাহকেরা যে-সব ধ্যানধারণাকে ঘৃণার চোখে দেখতে শিখেছিলেন, আদিকালে তাঁদেরই পূর্বপুরুষেরা ওই সব ধ্যানধারণাকেই সত্য বলে মনে করেছেন!

সংহিতা, ব্রাহ্মণ, উপনিষদ নামের যে সাহিত্যরাশি তা রাতারাতি রচিত হয় নি, অনেক যুগ সময় লেগেছিলো,–ঠিক যে কতো শতাব্দী তার নিখুঁত হিসেব দেবার মতো ঐতিহাসিক গবেষণা এখনো বাকি আছে। কিন্তু সন-তারিখের হিসাব নিয়ে সুনিশ্চিত হতে না পারলেও অন্তত এটুকু কথা জোর গলায় বলবার মতো দলিল রয়েছে যে ওই কয়েক শতাব্দী ধরে বৈদিক মানুষেরা একই রকমের সমাজ-ব্যবস্থায় বাস করেন নি। তাঁদের সমাজজীবনে অনেক অদলবদল হয়েছে এবং সেই অদলবদলের পরিণাম হিসাবেই তাঁদের ধ্যানধারণাতেও অনেক রকম মৌলিক পরিবর্তন ঘটেছে, এইভাবে বদলাতে বদলাতে বৈদিক ঐতিহ্য শেষ পর্যন্ত উপনিষদের অধ্যাত্মবাদের রূপ পেলো, এবং তারো অনেক পরের যুগে শঙ্করাচার্য প্রমুখ দার্শনিকেরা নিজেদের চূড়ান্ত ভাববাদী দর্শনকে পেশ করবার সময় প্রচার করবার প্রাণপাত চেষ্টা করলেন যে তাঁদের ভাববাদটা নিষক ঔপনিষদিক বা বৈদান্তিক চিন্তাই। বেদের শেষে জুড়ে দেওয়া হয়েছিল বলেই উপনিষদের আর একটি নাম বেদান্ত। এবং, শঙ্কর প্রমুখ দার্শনিকদের রচনা সাধারণভাবে দেশে এই ধারণাই সৃষ্টি করেছে যে বৈদিক সাহিত্যের আগাগোড়াই বুঝি ওই রকমের নিটোল অধ্যাত্মবাদ ও ভাববাদ।

সিদ্ধিদাতা কিন্তু এই ধারণাটিকে সন্দেহ করতে শেখান। কেননা গণপতিকে দেখতে পাবেন খোদ সংহিতাসাহিত্যের মধ্যেই। ঋগ্বেদ(৪৮)-এ পাবেন। যজুর্ব্বেদ(৪৯)-এ পাবেন। এবং, যেটা আরো বিস্ময়কর ব্যাপার, ঋগ্বেদ(৫০)-এ দেখবেন স্বয়ং বৃহস্পতির সঙ্গে গণপতির কোনো তফাত নেই। কথাটা জরুরী। কেননা, লোকায়ত দর্শনের আদিগুরু বলে যাঁর খ্যাতি তাঁর নামও বৃহস্পতিই।

আপত্তি উঠবে, নামে কী এসে যায়? ঋগ্বেদের ওই বৃহস্পতির সঙ্গে লোকায়ত-দর্শনের সত্যিই কোনো সম্পর্ক আছে কিনা তা খুবই সন্দেহের কথা। অন্তত কোনো রকম বাস্তব সম্পর্ক আজো ঐতিহাসিকভাবে প্রমাণিত হয় নি।

তা অবশ্য হয় নি। কিন্তু এতোদিন ধরে দেশে যে-ঐতিহ্যটা চলে আসছে তাকেও এক কথায় উড়িয়ে দেওয়া তো যায় না!

তাছাড়া, কথা হলো বৈদিক ঐতিহ্যের সঙ্গে লোকায়তিক ধ্যানধারণার সম্পর্ক শুধুমাত্র ওই নামটিকে আশ্রয় করেই নেই। বস্তুবাদী চেতনার,–এমনকি ওই বামাচারী চেতনারও,–অজস্র স্মারক বৈদিক সাহিত্যে ছড়ানো রয়েছে। এতো অজস্র যে সেগুলিকে খুঁজে পাবার জন্যে খুব বড়োসড়ো বেদজ্ঞ পণ্ডিত হবারও প্রয়োজন নেই। এই বই-এর দ্বিতীয় পরিচ্ছেদেই এ-ধরনের কিছু কিছু চিহ্ন বিশ্লেষণ করবার চেষ্টা করেছি।

—————————
৪৮. ঋগ্বেদ ২.২৩.১।
৪৯. বাজসনেয়ী সংহিতা ২৩.১৯।
৫০. ঋগ্বেদ ২.২৩.১ cf. R. G. Bhandarkar VS 147ff.