০২. নানা ধর্মমত

পূর্বে অনেক জায়গায় আভাস দিয়াছি যে, জৈন ধর্ম, বৌদ্ধ ধর্ম, আজীবক ধর্ম এবং যে সকল ধর্মকে বৌদ্ধেরা তৈর্থিক মত বলিত, সে-সকল ধর্মই বঙ্গ মগধ ও চের জাতির প্রাচীন ধর্ম, প্রাচীন আচার, প্রাচীন ব্যবহার, প্রাচীন রীতি, প্রাচীন নীতির উপরই স্থাপিত। আর্যজাতির ধর্মের উপর উহা ততটা নির্ভর করে না। এ কথা যদি সত্য হয়, তাহা হইলে ইহা বঙ্গদেশের কম গৌরবের কথা নয়। এরূপ মনে করিবার অনেকগুলি কারণ আছে। এই সকল ধর্মেরই উৎপত্তি পূর্বভারতে বঙ্গ মগধ ও চের জাতির অধিকারের মধ্যে, যে সকল দেশের সহিত আর্যগণের ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ ছিল সে সকল দেশের বাহিরে। এ সকল ধর্মই বৈরাগ্যের ধর্ম। বৈদিক আর্যদের ধর্ম সম্পূর্ণরূপে গৃহস্থের ধর্ম। ঋগ্বেদে বৈরাগ্যের নাম গন্ধও নাই। অন্যান্য বেগেও যাগযজ্ঞের কথাই অধিক, সেও গৃহস্থেরই ধর্ম সূত্রগুলিতেও গৃহস্থের ধর্মের কথা। এক ভাগ সূত্রের নামই তো গৃহ্যসূত্র। সূত্রগুলিতে চারি আশ্রম পালনের কথা আছে। শেষ আশ্রমের নাম ভিক্ষুর আশ্রম। ভিক্ষুর আশ্রমেও বিশেষ বৈরাগ্যের কথা দেখা যায় না। এ আশ্রমের লোক ভিক্ষা করিয়াই খাইবেন, এই কথাই আছে। কিন্তু আমরা যে সকল ধর্মের কথা বলিতেছি, তাহাদের সকলেই বলিতেছে গৃহস্থ-আশ্রম ত্যাগ করো। গৃহস্থ-আশ্রমে কেবল দুঃখ। গৃহস্থ-আশ্রম ত্যাগ করিয়া যাহাতে জন্ম, জরা, মরণ—এই ত্রিতাপ নাশ হয় তাহারই ব্যবস্থা করো। আর তাহা নাশ করিতে গেলে “আমি কে?”, “কোথা হইতে আসিলাম?”, “কেন আসিলাম?”—এই সকল বিষয় চিন্তা করিতে হয়। সেই চিন্তার ফলে কেহ বলেন আত্মা থাকে, কিন্তু সে ‘কেবল’ হইয়া যায়, সংসারের সহিত তাহার আর কোন সংস্রব থাকে না, সুতরাং সে জরামরণাদির অতীত। কেহ বলেন, তাহার অহংকার থাকে না; যখন তাহার অহংকার থাকে না, তখন সে সর্বব্যাপী হয়, সর্বভূতে সমজ্ঞান হয়, মহাকরুণার আধার হইয়া যায়। এসকল কথা বেদ ব্রাহ্মণ বা সূত্রে নাই। এ সব ত গেল দর্শনের কথা, চিন্তাশক্তির কথা, যোগের কথা।

বাহিরের দিক হইতেও দেখিতে গেলে, এই সকল ধর্মের ও আর্যধর্মের আচার-ব্যবহারে মিল নাই। আর্যগণ বলেন, পরিষ্কার কাপড় পরিবে, সর্বদা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকিবে, নিত্য স্নান করিবে। জৈনেরা বলেন, উলঙ্গ থাকো, গায়ের ময়লা তুলিও না, স্নান করিও না। মহাবীর মলভার বহন করিতেন। অনেক জোন যতি গৌরব করিয়া ‘মলধারী’ এই উপাধি ধারণ করিতেন। আর্যগণ উষ্ণীয়, উপানহ ও উপবীত ধারণ করিতেন; তাঁহারা খালি মাথায় থাকিতেন, জুতা পরিতেন না, এক ধুতি ও এক চাদরেই কাটাইয়া দিতেন। আর্যগণ সর্বদাই খেউরি হইতেন। অনেক ধর্মসম্প্রদায় একেবারে খেউরি হইত না। তাহাদের নখ চুল কখনো কাটা হইত না। আর্যেরা মাথা মুড়াইলে মাথার মাঝখানে একটা টিকি রাখিতেন। বৌদ্ধরা সব মাথা মুড়াইয়া ফেলিত। আর্যগণ দিনে একবার খাইতেন, রাত্রিতে একবার খাইতেন। বৌদ্ধরা বেলা বারোটার মধ্যে আহার করিত, বারোটার মধ্যে আহার না হইয়া উঠিলে তাহাদের সেদিন আর আহারই হইত না। রাত্রিতে তাহারা রস বা জলীয় পদার্থ ভিন্ন আর কিছুই খাইতে পারিত না। খাট ছাড়া আর্যগণের শয়ন হইত না। বৌদ্ধেরা উচ্চাসন মহাসন একেবারে ত্যাগ করিত, তাহারা মাটিতেই শুইয়া থাকিত। আর্যগণ সংস্কৃতে লেখাপড়া করিতেন, অন্য সকল ধর্মের লোক নিজ দেশের ভাষাতেই লেখাপড়া করিত।

ইহারা এত নূতন জিনিস কোথা হইতে পাইল? এ সকল নূতন জিনিস যখন আর্যদের মতের বিরোধী, তখন তাহারা আর্যদের নিকট হইতে সে সব পায় নাই। উত্তর হইতে তাহারা এই সব জিনিস পাইতে পারে না, কেননা উত্তরে হিমালয় পর্বত। হিমালয়ের উত্তরদেশের লোকের সহিত তাহাদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকিতেই পারে না। দক্ষিণ হইতেও ঐ সব জিনিস আসিতে পারে না, কেননা দক্ষিণের সহিত তাহাদের যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল, তাহার কোন প্রমাণ নাই; বরং বিন্ধ্যগিরি পার হইয়া যাওয়া অত্যন্ত কঠিন। সুতরাং যাহা কিছু উহারা পাইয়াছে, পূর্বাঞ্চল হইতেই পাইয়াছে এবং পূর্বাঞ্চলেই আমরা এই সকল নূতন জিনিস কতক কতক এখনও দেখিতে পাই।

জৈনদের শেষ তীর্থংকর মহাবীর ত্রিশ বৎসর বয়সে সংসার ত্যাগ করেন, তাহার পর কিছুদিন বৈশালির জৈনমন্দিরে বাস করেন, তাহার পর বারো বৎসর নিরুদ্দেশ থাকেন। এ সময় তিনি পূর্বাঞ্চলেই ভ্রমণ করিতেন। বারো বৎসরের পর তিনি জ্ঞান লাভ করিয়া বৈশালিতে ফিরিয়া আসেন। তাঁহারও পূর্বের তীর্থংকর পার্শ্বনাথ কাশীতে জন্মগ্রহণ করেন, ত্রিশ বৎসর বয়সে সংসার ত্যাগ করেন, তাহার পএ নানাদেশে ভ্রমণ করেন। তাঁহার ভ্রমণও পূর্বাঞ্চলেই অধিক। শেষ জীবনে তিনি সমেতগিরিতে বাস করেন—সমেতগিরি পরেশনাথ পাহাড়। তাঁহারও পূর্বে যে বাইশজন তীর্থংকর ছিলেন, তাঁহাদের মধ্যে অনেকেই সমেতগিরিতেই বাস করিতেন ও সেইখানেই দেহ রক্ষা করেন।

সাংখ্য-মত এই সকল ধর্মেরই আদি। সাংখ্যের দেখাদেখি জৈনেরা কেবলী হইতে চাহিত, কৈবল্য চাহিত। বৌদ্ধেরা বলেন, তাঁহারা সাংখ্যকে ছাড়াইয়া উঠিয়াছিলেন। কিন্তু সাংখ্য-মত আর্য মত নহে, উহার উৎপত্তি পূর্বদেশে। কতকগুলি আধুনিক সময়ের উপনিষৎ ও মনু প্রভৃতি কয়েকজন শিষ্টলোক উহার আদর করায়, শঙ্কর উহার খণ্ডন করিবার বিশেষ প্রয়াস পাইয়াছিলেন। এ কথা তিনি স্পষ্টাক্ষরে বলিয়ে গিয়াছেন। নচেৎ তাঁহার মতে উহা শিষ্টগণের গ্রাহ্য নহে। উপনিষদে যে সাংখ্য-মত আছে, শঙ্কর তাহাও স্বীকার করেন না—বলেন, ও সকলের অর্থ অন্যরূপ। সাংখ্যকার কপিলের বাড়ি পূর্বাঞ্চলে, পঞ্চশিখের বাড়িঈ পূর্বাঞ্চলে। মহাভারতের শান্তিপর্ব ‘অত্রাপ্যুদাহরস্থীমহিতিহাসং পুরাতনং’ বলিয়া আরম্ভ করিয়া এক জায়গায় বলিয়া গিয়াছে যে, পঞ্চশিখ জনকরাজার রাজসভায় আসিয়া রাজাকে উপদেশ দেন। সাংখ্য-মত যে পূর্বাঞ্চলের, এ কথা অনেক বার বলিয়াছি। তাই আর এখানে বেশী করিয়া বলিব না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *