প্রত্যেক লেখকই নিজের দেশের স্থানীয় মেজাজে বিরক্ত
এটি বোর্হেসের প্রথম সাক্ষাত্কার-গ্রন্থের অংশবিশেষ। বইটি লেখক হিসেবে বোর্হেসের পরিচয়কে অনেক বেশি প্রসারিত করেছিল। সাক্ষাত্কারটি নেন রিচার্ড বার্জিন। যুক্তরাষ্ট্রে। বার্জিনের তখন ২০ বছর। বোর্হেস এখানে পৃথিবীর অনেক খ্যাতিমান লেখক সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন। অনুবাদ করেছেন রাজু আলাউদ্দিন
বার্জিন: চেখফের মতো লেখক সম্পর্কে আপনার কী অভিমত? তাঁকে কি আপনার কাছে বেশি আবেদনময় মনে হয়?
বোর্হেস: চেখফ, হ্যাঁ, আমার মনে হয় তিনি ভালো লেখক। কিন্তু যেমন, দস্তয়েভস্কির চরিত্ররা বড় বেশি উঁচুস্বরে ব্যাখ্যা দিতে বাধ্য হচ্ছে। আমার মনে হয় না মানুষ ও রকম করে। রাশিয়ার লোকজন সম্ভবত ও রকম করে।
বার্জিন: তলস্তয়ের চরিত্র সম্পর্কে আপনার অভিমত কী? তারা কি বেশি স্বাভাবিক?
বোর্হেস: আমি ওয়ার অ্যান্ড পিস পড়তে শুরু করেছিলাম। পরে হঠাত্ করে মনে হলো আমি চরিত্রগুলোর ব্যাপারে আগ্রহী হতে পারছি না।
বার্জিন: এবং আপনি তলস্তয়ের আর কোনো বই পড়েননি?
বোর্হেস: তার কিছু ছোটগল্প পড়েছি। পড়তে কষ্ট হয়। পড়ার সময় কষ্টকর মনে হওয়াটা আমার ভালো লাগে না। অর্থাত্ অঙ্কশাস্ত্র বা মনোবিজ্ঞান কিংবা দর্শন পড়তে গিয়ে সেটা হতে পারে কিন্তু গল্প বা উপন্যাস পড়তে গিয়ে আমি সেই কষ্টকর অনুভূতি পেতে চাই না। পড়ে আনন্দ পেতে চাই। বুঝি না কেন গল্প বা উপন্যাসের লেখক পাঠককে ভোগাবেন। মনে পড়ছে তলস্তয় সম্পর্কে জর্জ মুর লিখেছিলেন, তিনি ১২ জন জুরি সম্পর্কে এমনভাবে বর্ণনা দিয়েছেন যে পড়তে পড়তে চার নম্বর জনে এসে ঠেকলে প্রথম জনের কথা মনেই থাকে না। তবে আমাকে যদি ইংরেজি এবং রুশ সাহিত্য, কিংবা ধরা যাক, ডিকেন্স এবং তলস্তয়ের মধ্যে কাউকে পছন্দ করতে বলা হয় তাহলে আমি ডিকেন্সকেই পছন্দ করব। কারণ ডিকেন্সকে জীবনের প্রতি সত্ বলে মনে হয়। সম্ভবত জীবনের চেয়ে বড় কিছু মনে হয়। আমার মনে হয় ডিকেন্সকে আজকাল সেভাবে মূল্য দেওয়া হয় না, যদিও চেস্টারটন তাঁর যথাসাধ্য মূল্যায়ন করেছেন।
বার্জিন: শুনেছি আপনি এখন চিত্রনাট্য লিখছেন। আপনি তো ভালো দেখতে পান না, কীভাবে কাজ করছেন?
বোর্হেস: আমি তো কেবল সংলাপটুকু লিখছি। তা ছাড়া আমি কল্পনা করতে পারি, আমার সময় শত শত বা হাজার হাজার ছবি দেখেছি। আমি একটি সিনেমা কল্পনা করতে পারি।
বার্জিন: অবশ্যই, আমি তা জানি, আপনি সিনেমার কিছু সমালোচনাও লিখেছেন।
বোর্হেস: হ্যাঁ। আমি সিনেমার খুবই ভক্ত। বুয়েনস আইরেসের লোকেরা এখানে (যুক্তরাষ্ট্র) যত ছবি দেখে তার চেয়ে অনেক বেশি দেখে বুয়েনস আইরেসে। বুয়েনস আইরেসে আপনি প্রতিদিন ভিন্ন ভিন্ন ধরনের চল্লিশটি সিনেমার মধ্যে বাছাই করে দেখার সুযোগ পাবেন। এই ছবিগুলোর বেশির ভাগই আমেরিকান। তবে আপনি সুইডিশ, ইংলিশ, ফরাসি, ইতালীয় বা রুশ সিনেমাগুলোও দেখতে পাবেন।
বার্জিন: আপনার দি ইনভ্যাশন ছবির প্লট সম্পর্কে আমাকে কিছু বলুন।
বোর্হেস: ছবিটির কাহিনী অনেকটা কল্পনাভিত্তিক। কাহিনীটা হচ্ছে একটি শহর আক্রান্ত হওয়ার উপক্রম হয়—কর্তৃপক্ষ কোনো পদক্ষেপই নেয় না। আক্রমণকারীরা খুবই নির্দয় ও শক্তিশালী। অবশেষে আক্রান্ত শহরটি রক্ষা করা হয়।
বার্জিন: ছবিটি মহাকাব্যধর্মী মনে হচ্ছে।
বোর্হেস: আমি মনে করি, এটা মজার ছবি হওয়া উচিত। কারণ এই ধরনের চরিত্র রয়েছে, চরিত্রগুলো আলাদা বৈশিষ্ট্যের, যেমন কিছু মহাকাব্যধর্মী মুহূর্ত আছে। কাপুরুষ ধরনের একজন লোক আছে সে আবার শহর রক্ষাকারীদের একজন। অন্য বন্ধুরা তাকে গ্রহণ করল। কারণ তারা সবাই তাকে কাপুরুষ হিসেবে জানে। ছবিটিতে এমন একটি মুহূর্ত আসে যখন প্রতিরক্ষা দলের একজনকে প্রাণ উত্সর্গ করতে হবে। তাদের মধ্য থেকে কাউকে কাজটি করতে হবে। এই কাপুরুষ লোকটি বলল, ‘শোন, আমি যেতে চাই। হ্যাঁ, তোমরা সবাই খুবই দক্ষ, তোমরা সাহসী, তোমাদের দরকার আছে। আমি কী করতে পারি? তোমরা সবাই আমাকে দয়া করে দলে নিয়েছ। আমি জানি আমার সম্পর্কে তোমরা কী ভাব, তা ছাড়া আরও গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হচ্ছে আমি নিজের সম্পর্কে কী ভাবি। আমি যা করতে পারি তা হচ্ছে নিজেকে উত্সর্গ করা। সুতরাং আমাকে যেতে দাও।’ অন্যরা তাকে ‘ধন্যবাদ’ জানাল এবং তার সঙ্গে করমর্দন করল। তারপর লোকটি চলে গেল এবং নিহত হলো। এ রকম আরও অনেক মুহূর্ত আছে।
বার্জিন: অভিনয়ে কখনো আগ্রহ বোধ করেছেন?
বোর্হেস: না…এখন জানি না যদি বলি আমি যখন ও’নীল পড়ি তখন আমার মনে দাগ কাটে না। আমি দি গ্রেট গড ব্রাউন দেখতে গিয়েছিলাম এবং অভিভূত হয়েছি। কারণ আপনি যখন মুখোশ দেখতে পান না তখন আপনাকে সেটা নাড়া দেয় না। চরিত্ররা মুখোশ পরে এবং পরে তা টেবিলে রেখে দেয়। পুরো ব্যাপারটাকে আপনি নির্বোধ কর্মকাণ্ড বলে মনে করতে পারেন। বরং ছেলেমি কাণ্ডই বলা যায়। কিন্তু যখন অভিনীত হয়, তখন তা একেবারেই ভিন্ন কিছু।
আমি হয়তো ও’নীলের প্রতি অবিচারই করছি। হতে পারে, কারণ আমি বার্নার্ড শ পড়েছি। তিনি নাটক লিখেছেন এবং এমনভাবে প্রকাশ করেছেন যাতে উপন্যাসের মতো করে পড়া যায়। শ-এর নাটকে আপনি আসবাবপত্রের দীর্ঘ বর্ণনা, এমনকি বইয়ের তাকেরও বর্ণনা পাবেন। পাবেন চরিত্রদের সম্পর্কে দীর্ঘ বর্ণনা, আপনি তাদের কল্পনা করতে পারবেন। কিন্তু ও’নীলের ক্ষেত্রে দেখবেন, তিনি বলছেন, ‘ক’ প্রবেশ করল, ‘খ’ ঢুকল। তাদের কীভাবে দেখতে হবে, কিংবা তারা কী—আপনি তা জানেন না, তাই না? না, নাটক তিনি পড়ার জন্য লেখেন না, লেখেন মঞ্চায়িত করার জন্য।
বার্জিন: লোরকার নাটক সম্পর্কে আপনার কী অভিমত?
বোর্হেস: ভালো লাগে না। লোরকা আমি কখনোই উপভোগ করিনি।
বার্জিন: তাঁর কবিতা?
বোর্হেস: না। ইয়ের্মা দেখে আমার এতটাই নির্বোধ মনে হয়েছে যে বেরিয়ে গেছি হল থেকে। একেবারেই ভালো লাগেনি।
বার্জিন: বেশ কিছু কারণে লোরকা তাঁর দেশে আদর্শায়িত ব্যক্তিত্ব।
বোর্হেস: আমার মনে হয়, নিহত হওয়ার ফলে সে সৌভাগ্য অর্জন করেছেন, তাই না? বুয়েনস আইরেসে তাঁর সঙ্গে আমার এক ঘণ্টা আড্ডা হয়েছিল। আমাকে তিনি নাট্যাভিনেতা হিসেবে আকর্ষণ করেছেন। নির্দিষ্ট কোনো চরিত্রে উতরে যান। অর্থাত্ পেশাদার আন্দালুসীয় হিসেবে।
বার্জিন: মনে হয় ককতো যেমনটা ছিলেন।
বোর্হেস: হ্যাঁ, মনে হয় তিনি সে রকমই ছিলেন। কিন্তু লোরকার ক্ষেত্রে ব্যাপারটা খুবই অদ্ভুত। কারণ আন্দালুসীয়রা ও রকম নয় মোটেই। আমি আন্দালুসিয়াতে কিছুদিন ছিলাম। হতে পারে তিনি হয়তো ভেবেছেন বুয়েনস আইরেসে ওই চরিত্রকে উতরে নিতে হবে। তবে আন্দালুসিয়ার লোকজন ও রকম নয়। আসলে, আপনি যদি আন্দালুসিয়ায় যান, আপনি যদি কোনো শিক্ষিত লোকের সাথে আলাপ করেন এবং আপনি যদি তাকে বুলফাইট সম্পর্কে বলেন, তাহলে তিনি বলবেন ‘হ্যাঁ, সাধারণ মানুষ এটা উপভোগ করে। কিন্তু বুলফাইটারের পেশা আসলেই বিপজ্জনক কিছু না।’ এসব তাদের কাছে ক্লিশে ব্যাপার। প্রত্যেক লেখকই তার নিজের দেশের স্থানীয় মেজাজে বিরক্ত। আমার সাথে লোরকার যখন দেখা হয়েছিল তখন তিনি পেশাদার আন্দালুসীয় হিসেবেই আবির্ভূত হয়েছেন।
বার্জিন: সার্ত্রের সঙ্গেও আপনার একবার দেখা হয়েছিল। পরে আর দেখা হয়নি?
বোর্হেস: না। তবে লোরকার চেয়ে সার্ত্রে অনেক বুদ্ধিদীপ্ত মানুষ। তা ছাড়া লোরকা আমাদের তাক লাগিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। আমাকে তিনি বলেছিলেন, সমসাময়িক বিশ্বের একটা গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র নিয়ে বেশ চিন্তায় আছেন, যে-চরিত্রের মধ্যে আপনি মার্কিনি জীবনের সব ধরনের ট্র্যাজেডি খুঁজে পাবেন। এভাবে তিনি অনেক কিছু বলতে থাকলেন। পরে আমি জিজ্ঞেস করলাম, সেটা কোন চরিত্র। তিনি বললেন চরিত্রটি হচ্ছে ‘মিকি মাউস’। আমি ভাবলাম তিনি বোধ হয় চালাকি করছেন। আমার মনে হলো একেবারে কাঁচা বয়সে কেউ হয়তো ওভাবে কথা বলে লোকজনকে তাক লাগিয়ে দিতে পারে। কিন্তু তিনি প্রাপ্তবয়স্ক। তাঁর ওসবের দরকার হয় না, তাঁর কথাবার্তা ভিন্ন হওয়া উচিত। কিন্তু যখন তিনি আমেরিকার প্রতীক হিসেবে মিকি মাউস সম্পর্কে শুরু করলেন—আমার এক বন্ধু ছিল সেখানে: আমরা পরস্পরের দিকে মুখ চাওয়াচাওয়ি করে দুজনেই বেরিয়ে পড়লাম। কারণ ওসব নিয়ে খেলা করার বয়স আমাদের নেই।
বার্জিন: তবে, লোরকা তো আর ভাবুক ছিলেন না, আমার ধারণা তিনি শব্দের ভান্ডারে সমৃদ্ধিশালী।
বোর্হেস: শব্দের গভীরে তেমন কিছু নেই।
বার্জিন: শব্দগুলো শ্রুতিমধুর।
বোর্হেস: বাচালতায় ভরা। যেমন, তিনি চমত্কার রূপক তৈরি করেন, কিন্তু সবকিছুই করেন আক্ষরিকতাকে প্রাধান্য দিয়ে। শব্দের বিপরীতে শব্দ নিয়ে খেলতে তিনি ভালোবাসেন। কিন্তু আদতে কী করেছেন সেটা তাঁর জানা নেই।
বার্জিন: পাবলো নেরুদা সম্পর্কে আপনার কী অভিমত? তাঁর সাথে দেখা-সাক্ষাত্ হয়েছে?
বোর্হেস: তাঁর সঙ্গে আমার একবার দেখা হয়েছিল। আমরা দুজনই তখন বেশ তরুণ। স্প্যানিশ ভাষা নিয়ে কথা হয়েছিল। আমরা একটা বিষয়ে একমত হয়েছিলাম যে স্প্যানিশ এতই জরদ্গব ভাষা যে এ ভাষায় কিছু করা সম্ভব না। আমি বললাম, সেই কারণেই এই ভাষায় তেমন কিছু হয়নি। তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ, ঠিকই বলেছেন, সে জন্যই স্প্যানিশ সাহিত্য বলে কিছু নেই।’ আমাদের কথাবার্তা ছিল হালকা ধরনের রসিকতাপূর্ণ।
বার্জিন: আমি জানি, আপনি নেরুদার কবিতা পছন্দ করেন, তাই না?
বোর্হেস: আমার ধারণা তিনি খুবই ভালো কবি, চমত্কার কবি। তবে, মানুষ হিসেবে তাকে আমার পছন্দ নয়। তিনি খুবই সংকীর্ণমনা মানুষ।
বার্জিন: কেন এ কথা বলেছেন?
বোর্হেস: তিনি একটি বই লিখেছিলেন—আমি হয়তো একটু রাজনৈতিক হয়ে যাচ্ছি—দক্ষিণ আমেরিকার স্বৈরশাসকদের নিয়ে একটি বই লিখেছিলেন, বেশ কিছু অংশ আমেরিকার বিরুদ্ধে। এখন তিনি জানেন এসবই রাবিশ। ওই বইতে পেরোন (হুয়ান পেরোন, আর্হেন্তিনার সাবেক ডিক্টেটর) সম্পর্কে তিনি টুঁ-শব্দও উচ্চারণ করেননি। কারণ বুয়েনস আইরেসে তাঁর বিরুদ্ধে একটি মামলা ছিল। পরে আমি জেনেছিলাম সে কথা। ওই সময় একটি মহত্ উদ্দেশ্য নিয়ে, মহান উপলব্ধি থেকে তাঁর রচনা সত্যের আলোকে আলোকিত হওয়া উচিত ছিল, অথচ তিনি পেরোন সম্পর্কে একটি কথাও বলেননি। তিনি আর্হেন্তিনার এক মেয়েকে বিয়ে করেছিলেন, তিনি জানতেন তাঁর অনেক বন্ধুকে জেলে ঢোকানো হয়েছে। আমাদের দেশের সার্বিক পরিস্থিতিই তিনি জানতেন, অথচ একটি কথাও বলেননি। ঠিক ওই সময়ই তিনি আমেরিকার বিরুদ্ধে বলছেন। তার মানে এই নয় যে তাঁর কবিতা সে কারণে গুরুত্বহীন হয়ে পড়বে। নেরুদা খুবই ভালো কবি, সত্যি বলতে কী এক মহান কবি। যখন ওই লোক (মিগেল আনহেল আস্তুরিয়াস, গুয়াতেমালার ঔপন্যাসিক) নোবেল পুরস্কার পেলেন তখন আমি বলেছিলাম, পুরস্কারটি নেরুদার পাওয়া উচিত ছিল।
আমি যখন চিলিতে ছিলাম, আমরা তখন ভিন্ন ভিন্ন রাজনৈতিক বিশ্বাসের মানুষ, আমি মনে করি তিনি একেবারে ঠিক কাজটিই করেছিলেন। আমাকে এড়িয়ে যাওয়ার জন্য তিনি অবসর কাটাতে কয়েক দিনের জন্য অন্য কোথাও চলে গেছেন। আমার ধারণা, তিনি বুঝেশুনেই সব করেছিলেন। তিনি জানতেন লোকজন তাঁকে আমার বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে পারে। আমি আর্হেন্তিনার, তিনি চিলির কবি। তিনি কমিউনিস্ট, আমি তার উল্টো। সুতরাং আমার সঙ্গে একই সমাবেশে উপস্থিত হওয়ার বিষয়টি বুদ্ধিমানের মতোই তিনি এড়িয়ে গেছেন।
বার্জিন: উনামুনোর (মিগেল দ্য উনামুনো, স্পেনের একজন প্রধান লেখক) সঙ্গে কখনো দেখা হয়েছে?
বোর্হেস: না, তিনি আমাকে একটি চমত্কার চিঠি লিখেছিলেন।
বার্জিন: হ্যাঁ আমার মনে হয় আপনি সে কথা উল্লেখ করেছিলেন।
বোর্হেস: হ্যাঁ, উনামুনো এক মহান লেখক। তাঁকে আমি খুবই শ্রদ্ধা করি।
বার্জিন: আপনি তাঁর কোন লেখাটি পছন্দ করেন?
বোর্হেস: ‘দন কিহোতে’ সম্পর্কে বইটি এবং তাঁর প্রবন্ধ।
বার্জিন: তাঁর লেখালেখির বাইরেও তিনি একজন মননশীল ব্যক্তিত্ব। আপনার কি তা-ই মনে হয়?
বোর্হেস: নিঃসন্দেহে। এক মহত্ মনের মানুষ। তাঁর বিপক্ষে শুধু এই বলা যায় যে আমার যাতে আগ্রহ নেই তিনি সে বিষয়ে আগ্রহী। তিনি ব্যক্তিগত অমরত্ব নিয়ে খুবই চিন্তিত। তাঁর বক্তব্য, ‘আমি মিগেল দে উনামুনো হিসেবেই প্রবাহিত হতে চাই।’ আমি হোর্হে লুইস বোর্হেস হিসেবে প্রবাহিত হতে চাই না। আমি যদি আবার জন্মাই তাহলে সেই আগের ‘আমি’র স্মৃতি বা কোনো কিছুই ধারণ করতে চাই না। অর্থাত্ এই বোর্হেসরূপে থাকতে চাই না। আমি তাঁর সবকিছু ভুলে যেতে চাই। তবে এসবই নিতান্ত ব্যক্তিগত ভিন্নতা। ব্যাপারটা এভাবে বলা যায় যে আমি কফি পছন্দ করি আর তিনি চা; কিংবা আমি পছন্দ করি সমতলভূমি তিনি ভালোবাসেন পাহাড়-পর্বত, তাই না?
বার্জিন: সাহিত্যের বাইরে আপনি অন্য কোনো শিল্পকলা উপভোগ করেন কি? আমি জানি সাহিত্যের মতো আর অন্য কিছুতে আপনি অতটা অনুরক্ত নন। তো অন্য কোন শিল্প আপনার ভালো লাগে?
বোর্হেস: যেমন, বিঅয় কাসারেসের (আর্হেন্তিনার লেখক, বোর্হেসের বন্ধু, কয়েকটি বইয়ের সহলেখক) সঙ্গে আমি যখন লিখতাম তখন ওর স্ত্রী সব সময় গ্রামোফোন রেকর্ড চালিয়ে দিত। কিছু সময় পরে, আমাদের মনে হতো দূরের কোনো ঘর থেকে সংগীত ভেসে আসছে। বাড়িটা ছিল বিশাল। এক ধরনের সংগীত ছিল যা আমাদের ভালো লাগত, আমাদের উদ্দীপ্ত করত, সম্ভবত আমাদের দিয়ে ভালো কিছু লিখিয়ে নিত। পরে আমরা তাকে বলতাম অন্য কিছু বাজাতে। তিনি নানা ধরনের জিনিস বাজিয়ে পরীক্ষা চালাতেন। পরে আমরা দেখলাম যে যখন দিবুসি বাজাতেন তখন আমাদের ভালো লাগত না। র্যাভেলও না। বাখ্ও আমাদের খুব একটা ছুঁয়ে যেত না। তবে যখন ব্রাহম চড়াতেন, তখন মনে হতো এটাই হচ্ছে আমাদের জিনিস।
বার্জিন: স্ত্রাভিনিস্কি শুনেছেন কখনো?
বোর্হেস: স্ত্রাভিনিস্কি। একবার এক কনসার্টে তাঁকে শুনেছিলাম। মনে হয়েছিল আমি মাতাল হয়ে গেছি। আমার এত ভালো, এতটা ভালো লেগেছিল যে আমি দ্বিতীয়বার আর শুনতে চাইনি। মনে হয়েছিল আবার শুনলে হয়তো হতাশ হয়ে যাব।
বার্জিন: যা শুনেছিলেন সেটার নাম কী ছিল?
বোর্হেস: জানি না। দুই-তিনজন প্রফেসর আমাকে বললেন আমি তাদের সাথে কনসার্টে যেতে চাই কি না। আমি বললাম, দেখুন, আমি আপনাদের সঙ্গে যাব আপনাদের সঙ্গ উপভোগ করার জন্য, তবে মনে হয় না আমি সংগীত উপভোগ করতে পারব, কারণ এ ব্যাপারে আমি খুবই অজ্ঞ। তাঁরা বললেন, ‘বেশ—, আপনার যদি ও নিয়ে দুশ্চিন্তা না থাকে তাহলে চলুন। ভালো লাগাতেই হবে এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই।’ আমি গেলাম এবং হঠাত্ করেই এক ধরনের আবেশ এবং সুখানুভূতি আমাকে জড়িয়ে ধরল। আমরা যখন বেরিয়ে এলাম তখন নিজেদের অসম্ভব বন্ধুময় মনে হলো, পরস্পর কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে আমরা অকারণেই হাসছিলাম। এই রকমই ছিল স্ত্রাভিনিস্কি।
[সাক্ষাত্কারটি নেওয়া হয় ১৯৬৯ সালে। সংক্ষেপিত]
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জানুয়ারী ২১, ২০১০
Leave a Reply